ইহুদি ধর্ম

 

ইহুদি ধর্ম (Judaism), যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন একেশ্বরবাদী ধর্ম, মধ্যপ্রাচ্যের ইস্রায়েল অঞ্চল থেকে উদ্ভূত। এটি ইহুদি জাতির ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ধর্ম, যা তাদের বিশ্বাস, ঐতিহ্য, এবং সামাজিক অনুশীলন দ্বারা প্রভাবিত। 

ইহুদি ধর্মের মূল বিশ্বাস একেশ্বরবাদ, যেখানে একক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর (যাকে ইয়াহওয়া বলা হয়) পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। ইহুদিরা বিশ্বাস করেন যে তাদের পূর্বপুরুষদের সাথে ঈশ্বরের একটি চুক্তি (ব্রিথ) হয়েছে, বিশেষত ইব্রাহিম (আব্রাহাম), ইসহাক, এবং যাকোবের সাথে। ইহুদিরা সিনাগগে উপাসনা করে, যা তাদের ধর্মীয় মন্দির। সেখানে রাবাই (ধর্মগুরু) নেতৃত্ব দেন। প্রতিদিনের প্রার্থনার জন্য শাচারিত (সকাল), মিনচাহ (বিকাল), এবং মাআরিভ (সন্ধ্যা) এই তিনটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে। ইহুদি পরিচয় কেবল ধর্মীয় নয়, এটি জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ও বহন করে। ইহুদি জনগণ সাধারণত একে অপরের সাথে ধর্মীয় ও জাতিগত বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। ইহুদিদের অনেকের ইস্রায়েলের সাথে একটি সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে।

ইতিহাস

হিব্রু বাইবেল বা তানাখ মূলত ইহুদিদের আদি ইতিহাস এবং ঈশ্বরের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের একটি বিস্তৃত বিবরণ। এটি বর্ণনা করে কিভাবে অব্রাহামকে ঈশ্বরের প্রতি অবিচল বিশ্বাসের জন্য ইহুদি জাতির পিতা হিসাবে সম্মানিত করা হয় এবং তার দ্বিতীয় পুত্র ইসহাকের বংশকে ইস্রায়েল বা প্রাচীন কনান দেশের উত্তরাধিকারী করা হয়। পরে, ইসহাকের পুত্র যাকোবের বংশধররা মিসরে ক্রীতদাসে পরিণত হলে, ঈশ্বর তাদের মোশির নেতৃত্বে মুক্তির জন্য নির্দেশ দেন। সীনয় পর্বতে মোশি ঈশ্বরের কাছ থেকে তোরাহ বা মোশির পাঁচটি পুস্তক লাভ করেন, যা নবীঈম (নবীদের পুস্তক) ও কতূবীমের (লিখিত পুস্তক) সঙ্গে মিলে তানাখ গঠিত হয়। পাশাপাশি, মৌখিক তোরাহের উপাদানসমূহ মিশনা ও তালমুদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এরপর ইহুদিরা ইস্রায়েলে আসে, যেখানে প্রায় ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিলো শহরে ঈশ্বরের পবিত্র তাম্বু স্থাপন করা হয়, যা শত্রুদের আক্রমণের বিরুদ্ধে জাতির মনোবল ধরে রাখতে সহায়তা করে। তবে, কালের পরিক্রমায় ইস্রায়েলীয়দের আধ্যাত্মিক অবস্থার অবনতি হলে, ঈশ্বর পলেষ্টীয়দের তাম্বুটি দখল করার সুযোগ দেন। জাতির প্রতিকূল অবস্থায় ইস্রায়েলীয়রা শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য নবী শমূয়েলের কাছে একজন স্থায়ী রাজা নিয়োগের অনুরোধ জানায়। তখন শমূয়েল শৌলকে প্রথম রাজা হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু পরে শৌল শাসনকালে শমূয়েলের আদেশ অমান্য করলে ঈশ্বর শমূয়েলকে নির্দেশ দেন যে তিনি শৌলের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দায়ূদকে রাজা নিযুক্ত করবেন।

রাজা দায়ূদের ইচ্ছা ছিল ঈশ্বরের জন্য একটি স্থায়ী মন্দির নির্মাণ করা, কিন্তু ঈশ্বর নবী নাথনকে জানিয়ে দেন যে দায়ূদের পরিবর্তে তাঁর পুত্র শলোমন এই মন্দির নির্মাণের অনুমতি পাবেন। এর প্রতিদানে ঈশ্বর দায়ূদকে একটি চিরস্থায়ী রাজবংশের প্রতিশ্রুতি দেন, যা শলোমনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে এবং তাঁদের বংশধরেরা কখনোই সিংহাসনচ্যুত হবে না। শলোমন পরে প্রথম মন্দির নির্মাণ করেন, যা ইহুদিদের উপাসনা ও আধ্যাত্মিক জীবনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

হিব্রু বাইবেল অনুযায়ী, শৌলের অধীনে একটি একক রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়, যা পরবর্তীতে রাজা দায়ূদ ও তাঁর পুত্র সলোমনের শাসনে আরও শক্তিশালী হয়। এই সময় জেরুজালেম রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠে এবং ইস্রায়েলীয় জাতি একক শাসনের অধীনে থাকে। তবে সলোমনের মৃত্যুর পরে এই রাজ্য বিভক্ত হয়ে উত্তর দিকে ইস্রায়েল ও দক্ষিণ দিকে জুডাহ নামে দুটি পৃথক রাজ্যে পরিণত হয়।

খ্রিস্টপূর্ব ৭২০ সালের দিকে নব্য-অ্যাসিরিয়ান সাম্রাজ্য উত্তর ইস্রায়েল রাজ্যকে আক্রমণ করে এবং রাজধানী সামারিয়া সহ এই অঞ্চলের দখল নেয়। এই দখলের ফলে অনেক ইস্রায়েলীয়কে বন্দী করে মিডিয়া এবং খাবুর নদী উপত্যকায় নিয়ে যাওয়া হয়। অন্যদিকে, জুডাহ রাজ্য ৫৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্বাধীন ছিল, কিন্তু নব্য-বাবিলনীয় সাম্রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় নেবুচাদনেজারের আক্রমণে এই স্বাধীনতা শেষ হয়। বাবিলনীয়রা জেরুজালেম শহর ও প্রথম মন্দির ধ্বংস করে দেয়, যা ইহুদিদের উপাসনার প্রধান কেন্দ্র ছিল।

এই আক্রমণের ফলে ইহুদিদের একটি বড় অংশকে বাবিলনে নির্বাসিত করা হয়, যা ইহুদি ইতিহাসের প্রথম বৃহৎ প্রবাসী জীবন হিসেবে পরিচিত। সত্তর বছর পরে, পারস্যের আচেমেনিড সাম্রাজ্য বাবিলন দখল করে এবং ইহুদিদের তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়। এই ফিরে আসার ঘটনাটি ‘জিওনে প্রত্যাবর্তন’ নামে পরিচিত। ফিরে এসে ইহুদিরা দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণ করে এবং তাদের প্রাচীন ধর্মীয় চর্চাগুলি পুনরায় শুরু করে, যা ইহুদি জাতির পুনর্জন্মে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

দ্বিতীয় মন্দিরের প্রারম্ভিক বছরগুলোতে, ইহুদি ধর্মীয় নেতৃত্বের মূল কেন্দ্র ছিল গ্রেট অ্যাসেম্বলি নামে পরিচিত একটি পরিষদ, যার নেতৃত্বে ছিলেন এজরা দ্য স্ক্রাইব। এই পরিষদের অধীনে বাইবেলের শেষ বইগুলো সংকলিত ও ক্যানন সিল করা হয়, অর্থাৎ বাইবেলের গ্রন্থগুলোকে একত্রিত করে একটি নির্দিষ্ট রূপ দেওয়া হয়, যা ধর্মগ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে হেলেনিস্টিক সংস্কৃতি টলেমাইক মিশর ও আশেপাশে ইহুদি ধর্মে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, যা ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটায়। এই দ্বন্দ্বের মূল প্রশ্ন ছিল—অন্য সংস্কৃতির সঙ্গে ইহুদি ঐতিহ্যকে কীভাবে সামঞ্জস্য করা যায়।

৬৬-৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গ্রেট ইহুদি বিদ্রোহের সময়, রোমানরা জেরুজালেম আক্রমণ করে এবং দ্বিতীয় মন্দির ধ্বংস করে, যা ইহুদি ধর্মের উপাসনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এরপর সম্রাট হ্যাড্রিয়ান টেম্পল মাউন্টে একটি পৌত্তলিক মূর্তি স্থাপন এবং ইহুদিদের ধর্মীয় আচার নিষিদ্ধ করেন, বিশেষ করে খৎনা। এই নিষেধাজ্ঞা ও অপমানের বিরুদ্ধে ইহুদিরা বার কোখবা বিদ্রোহ শুরু করে (১৩২-১৩৬ খ্রিস্টাব্দ), তবে বিদ্রোহের পরিণামে রোমানরা ইহুদিদের তোরাহ অধ্যয়ন এবং ধর্মীয় আচার নিষিদ্ধ করে এবং জুডিয়ার প্রায় সব ইহুদিদের সেখান থেকে নির্বাসিত করে দেয়।

২০০ খ্রিস্টাব্দে, ইহুদিরা রোমান নাগরিকত্ব পায়, এবং চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত ইহুদি ধর্মকে "বৈধ ধর্ম" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু জেরুজালেম ধ্বংস ও নির্বাসনের ফলে ইহুদি উপাসনার পদ্ধতিতেও বড় পরিবর্তন আসে; মন্দির-কেন্দ্রিক উপাসনা বিলুপ্ত হয়ে যায়, বলিদানের পরিবর্তে প্রার্থনা প্রধান উপাসনা হিসেবে গড়ে ওঠে, এবং উপাসনার স্থান হিসেবে সম্প্রদায়ভিত্তিক সভা বা সিনাগগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যেখানে অন্তত দশজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সমাগম হতো।

এ সময়ে রাব্বিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁরা ধর্মশিক্ষক ও সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে কাজ করতেন, এবং এই নেতৃত্বের মাধ্যমেই ইহুদি ধর্মীয় চর্চা ও শিক্ষার ধারা এগিয়ে চলে, যা ইহুদি পরিচিতির একটি নতুন রূপ গঠন করে।

রব্বিনীয় ঐতিহ্য অনুসারে, মৌখিক তোরাহ বা মৌখিক আইন, যা ঈশ্বর সীনয় পর্বতে মোশিকে সরাসরি বলেছিলেন, মূলত মুখস্থ রেখে সংরক্ষিত হতো। কিন্তু ক্রমবর্ধমান অত্যাচার ও ভুলে যাওয়ার ঝুঁকির কারণে প্রায় ২০০ খ্রিস্টাব্দে রব্বি যিহূদা হানাসি এই মৌখিক আইনের বিবরণ মিশনায় লিখিত আকারে সংরক্ষণ করেন। পরে এই মিশনা ও তার ব্যাখ্যা গমারার সংকলন তালমুদে যুক্ত হয়। তালমুদে ইহুদি আইনের আরও বিশদ বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে, যা ফিলিস্তিন ও বাবিলের বৃত্তিসমূহে পৃথকভাবে বিকশিত হয়েছিল। যিরূশালেমীয় তালমুদ ৪র্থ শতাব্দীতে ফিলিস্তিনে সংকলিত হয়, আর বাবিলীয় তালমুদ ৫০০ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ হয়, যদিও পরবর্তীকালে এই সংকলনে সংশোধনী যুক্ত হতে থাকে।

সমালোচনামূলক পণ্ডিতদের মতে, তোরাহর বিভিন্ন পাঠ্যে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে যা প্রাচীন সম্পাদকেরা একত্রিত করেছেন, ফলে বিভিন্ন সূত্র থেকে ভিন্ন বিবরণে ইস্রায়েলীয় ধর্মবিশ্বাসের বিবর্তন ফুটে ওঠে। অধ্যাপক মার্টিন রোজ ও জন ব্রাইটের মতে, প্রথম মন্দিরের যুগে ইস্রায়েলীয়দের মধ্যে এমন বিশ্বাস ছিল যে প্রতিটি জাতির নিজস্ব ঈশ্বর থাকে, কিন্তু তারা নিজেদের ঈশ্বরকে অন্যান্য ঈশ্বরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ মনে করত। এই দৃষ্টিভঙ্গি, যা মূলত বহুঈশ্বরবাদ বা শ্রেষ্ঠত্বের একেশ্বরবাদ বলে পরিচিত, সম্ভবত বাবিলীয় নির্বাসনের সময়ে পরিবর্তিত হয়ে কট্টর একেশ্বরবাদের দিকে ঝুঁকে যায়, যা জরথুস্ত্রীয় দ্বৈতবাদের প্রভাবকেও প্রতিফলিত করে থাকতে পারে।

অনেক গবেষক মনে করেন যে হেলেনীয় যুগের মধ্যেই ইহুদিরা এই ধারণায় পৌঁছায় যে তাদের ঈশ্বরই একমাত্র সত্য ঈশ্বর, এবং এর ফলে ইহুদি জাতি ও ধর্মের মধ্যে একটি অভিন্নতা গড়ে ওঠে। গবেষক জন ডে প্রাচীন কনানীয় ধর্মের প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বলেন যে ইহুদি ধর্মের ইয়াহওয়েহ, এল, আশেরা ও বালদেবের মতো চরিত্রগুলো কনানীয় দেবমণ্ডলীর ঐতিহ্য থেকে প্রভাবিত হতে পারে, যা গ্রীক দেবমণ্ডলীর মতো দেবতাদের একটি সমষ্টিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।

ধর্মীয় নীতিমালা

ইহুদি ধর্মে বেশ কিছু ধর্মীয় নীতি ও প্রথা রয়েছে, যা হালাখা নামে পরিচিত। এতে রয়েছে খাদ্য আইন (কশের), শবত (সপ্তাহের পবিত্র দিন), বিবাহ-বিচ্ছেদ, ব্যবসায়িক লেনদেন, এবং সামাজিক আচরণবিধি।

ইহুদি খাদ্য আইন, যা কশের বা কশরুত নামে পরিচিত, ইহুদিদের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্য গ্রহণের নিয়ম এবং বিধি নির্দেশ করে। এই বিধিগুলি হিব্রু বাইবেলে, বিশেষত তোরাহতে, বর্ণিত হয়েছে এবং পরে রাব্বিদের ব্যাখ্যার মাধ্যমে আরও বিস্তৃত হয়েছে। কশরুত আইন অনুসারে, কোন খাদ্য "কশের" অর্থাৎ ভোজ্য এবং ধর্মীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে, তা নির্ধারিত হয়। নির্দিষ্ট পশু, পাখি এবং মাছই কেবল কশের বলে বিবেচিত হয়। গরু, ছাগল, ভেড়া, এবং হরিণের মতো বিভক্ত খুরবিশিষ্ট এবং জাবর কাটে এমন প্রাণী কশের, কিন্তু শূকর এবং খচ্চর নিষিদ্ধ। জলজ প্রাণীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সেই মাছগুলো কশের, যেগুলোর পাখনা এবং আঁশ আছে; সুতরাং শুঁটকি, চিংড়ি এবং অন্যান্য খোলসযুক্ত মাছ কশের নয়। মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার একসঙ্গে রান্না, পরিবেশন এবং গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। মাংস এবং দুধের পাত্র ও সরঞ্জাম পৃথক রাখতে হয়, এমনকি খাবারের মাঝে নির্দিষ্ট সময় বিরতি দেওয়া হয়। কশের খাবারের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পশুদের জবাই করতে হয়, যা "শেখিতা" নামে পরিচিত। শেখিতায় পশুকে নির্দিষ্ট ধারালো ছুরি দিয়ে দ্রুত জবাই করা হয় যাতে পশু যন্ত্রণা না পায় এবং রক্তের নিষ্কাশন ভালোভাবে হয়। ইহুদি আইন অনুযায়ী, রক্ত ভোজ্য নয়, তাই মাংসের সম্পূর্ণ রক্ত অপসারণ করার জন্য লবণ দিয়ে প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। অধিকাংশ পোকামাকড় নিষিদ্ধ; তাই ফল ও শাকসবজি খাওয়ার আগে তা খুব ভালোভাবে পরিস্কার করা হয় যাতে কোনো পোকা না থাকে ।

ইহুদি ধর্মে শবত বা সবাথ সপ্তাহের পবিত্র দিন হিসেবে পরিচিত, যা শুক্রবার সূর্যাস্ত থেকে শনিবার সূর্যাস্ত পর্যন্ত পালিত হয়। এটি কাজ থেকে বিরতি নেওয়ার এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য একটি দিন। শবতের সময় পরিবারের সঙ্গে একত্রে প্রার্থনা, খাবার গ্রহণ, এবং ধর্মীয় পাঠের মাধ্যমে ইহুদি ধর্মীয় ঐতিহ্য পালন করা হয়। শবতের মূল উদ্দেশ্য হল সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কাজের পর বিশ্রাম নেওয়ার স্মরণ, যেমনটি বাইবেলে বলা হয়েছে যে ঈশ্বর সৃষ্টি কাজের পর সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। শবত চলাকালীন নির্দিষ্ট কাজ নিষিদ্ধ, যেমন—আগুন জ্বালানো, বিদ্যুৎ ব্যবহার করা, ব্যবসা-বাণিজ্য করা, এবং দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজ। এই নিয়মগুলো শবতকে একটি সম্পূর্ণ বিশ্রাম এবং ধর্মীয় অনুভূতির দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। 

ইহুদি ধর্মে বিবাহ-বিচ্ছেদ বা গেট (Get) একটি স্বীকৃত প্রক্রিয়া, তবে এটি ধর্মীয় বিধিনিষেধ মেনে সম্পন্ন করতে হয়। ইহুদি ধর্মে বিবাহকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ম মানতে হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্পন্ন করতে হলে স্বামীর পক্ষ থেকে একটি "গেট" নামক দলিল তৈরি করতে হয় এবং এটি স্ত্রীর হাতে দেওয়া হয়। এই গেট দলিলটি ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী একটি বৈধ বিবাহ-বিচ্ছেদের সনদ হিসেবে কাজ করে এবং শুধুমাত্র তখনই নারী ও পুরুষ পুনরায় বিবাহের অধিকারী হন।

এই প্রথায় বিবাহ-বিচ্ছেদ সম্ভব, কিন্তু তা ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে সম্পন্ন করতে হয় এবং প্রক্রিয়াটি কঠোরভাবে ধর্মীয় আইন মেনে পরিচালিত হয়। বিশেষ করে, "গেট" দলিলের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটে, যা ইহুদি ধর্মে পুনরায় একত্র হওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়।

পবিত্র গ্রন্থ

ইহুদি ধর্মের প্রধান পবিত্র গ্রন্থ হলো তানাখ, যা খ্রিস্টীয় বাইবেলের পুরাতন নিয়মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তানাখ তিনটি প্রধান অংশে বিভক্ত:

  • তোরাহ (ব্যবস্থা): এর মধ্যে পাঁচটি প্রধান বই আছে, যা পেন্টাটিউক নামে পরিচিত (যেমন: আদিপুস্তক, নির্গমন, লেবীয়, গণনা, এবং দ্বিতীয় বিবরণ)।
  • নেভিয়িম (নবী): ইস্রায়েলের নবীদের শিক্ষা এবং ঘটনা বিবরণ।
  • কেতুবিম (লেখা): বিভিন্ন কাব্যিক এবং জ্ঞানমূলক বই, যেমন যিশাইয়াহ, গীতসংহিতা, এবং দানিয়েল।

প্রধান উৎসব

ইহুদিরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ উৎসব উদযাপন করে যা তাদের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলির স্মরণে এবং ধর্মীয় গুরুত্বে অনুষ্ঠিত হয়:

  • পাসওভার (পেসাখ): মিশর থেকে ইহুদিদের মুক্তির স্মরণে।
  • হানুক্কাহ: মন্দির পুনর্নির্মাণ ও তেলের অলৌকিক ঘটনার স্মরণে।
  • রোশ হাসানাহ: ইহুদি নতুন বছর।
  • ইয়ম কিপ্পুর: পাপের ক্ষমার জন্য প্রার্থনা ও উপবাসের দিন।
  • সুক্কত: ইস্রায়েলিদের মরুভূমিতে থাকার স্মরণে উদযাপন।

ইহুদি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন শাখা

ইহুদি ধর্মে কিছু প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য আছে:

  • অর্থডক্স ইহুদি: কঠোর ঐতিহ্যবাহী বিধিবিধান মেনে চলা।
  • কনজারভেটিভ ইহুদি: ঐতিহ্য বজায় রেখে কিছু আধুনিকতাকে গ্রহণ।
  • রিফর্ম ইহুদি: বেশি উদারপন্থী এবং আধুনিক, যারা রীতি ও প্রথার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তনকে সমর্থন করেন।

ইহুদি মেসিয়াহ ধারণা

ইহুদি ধর্মে মেসিয়াহ বা মশিয়াহ (হিব্রু ভাষায়: משיח) ধারণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর ঐতিহ্যবাহী বিশ্বাস, যা পুরনো বাইবেলের বিভিন্ন অংশে প্রতিফলিত হয়েছে। ইহুদি বিশ্বাস অনুসারে, মশিয়াহ একজন দেব-নিযুক্ত নেতা হবেন, যিনি ইস্রায়েলের জনগণের মুক্তি আনবেন এবং বিশ্বে ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন। ইহুদি ধর্মে মশিয়াহ একটি বিশেষ ব্যক্তিত্ব, যিনি সরাসরি দায়িত্ব নিয়ে আসবেন মানবজাতির কল্যাণে। ধারণাটি অনুযায়ী, মশিয়াহ হবেন দাউদ রাজবংশের একজন সৎ এবং ধর্মপ্রাণ নেতা, যিনি ইহুদি জনগণের স্বাধীনতা ও তাদের ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করবেন। তিনি ইহুদিদের পবিত্র ভূমিতে পুনর্বাসন করবেন, সমগ্র বিশ্বের মন্দির পুনর্নির্মাণ করবেন, এবং বিশ্বে এক নতুন যুগের সূচনা করবেন যেখানে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও নিষ্ঠা প্রতিষ্ঠিত হবে।

ইহুদি ধর্মে মশিয়াহের আগমনকে একটি নতুন যুগের সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। একে ‘আখরিত হায়ামিম’ বা শেষ দিনের যুগও বলা হয়, যার মাধ্যমে গোটা বিশ্বে মানবিকতা, ন্যায়বিচার, এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের এক নূতন মাত্রা দেখা দেবে। এই নতুন যুগে যুদ্ধ বন্ধ হবে, দারিদ্র্য দূর হবে এবং মানুষ পরস্পরের প্রতি আরও সংবেদনশীল হবে।

মশিয়াহ ধারণা ইহুদি ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষত তানাখ-এর অংশগুলি (যেমন: ইশাইয়াহুইরেমিয়াহু, এবং ইজেকিয়েল) মশিয়াহ সংক্রান্ত বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী তুলে ধরে। এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলিতে উল্লেখ করা হয়েছে একজন মশিয়াহ যিনি শাসক, বিচারক, এবং নেতা হিসেবে মানুষকে নতুন যুগে পরিচালিত করবেন। মশিয়াহ ধারণাটি ইহুদি জাতীয় চেতনায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এটি ইহুদি সম্প্রদায়ের ঐক্য এবং ঐতিহ্য রক্ষার একটি কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অনেক ইহুদি ধর্মীয় শাখা মশিয়াহ নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করে থাকে। কিছু শাখা এটিকে ভবিষ্যতে ঘটবে বলে বিশ্বাস করে, আবার কেউ কেউ একে প্রতীকী অর্থে দেখেন। তবে সমস্ত ইহুদি সম্প্রদায়ই এটিকে আশার একটি চিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করে।


Post a Comment

Previous Post Next Post