ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি

ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি (Muhammad Bakhtiyar Khalji) (ফার্সি: اختيار الدين محمد بن بختيار الخلجي), যিনি বখতিয়ার খলজি নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন ঘুরি সাম্রাজ্যের একজন তুর্কি-আফগান সেনাপতি এবং প্রাথমিক দিল্লি সালতানাতের একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নেতা। তিনি প্রথম মুসলিম সেনাপতি হিসেবে বাংলা ও বিহারের কিছু অঞ্চল জয় করেন এবং বাংলায় খলজি রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনকাল ১২০৩ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য স্থায়ী ছিল।

১১৯৭ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বখতিয়ারের নেতৃত্বে ভারতবর্ষে একাধিক সামরিক আক্রমণ সংঘটিত হয়। এসব অভিযানের ফলে উত্তর ভারতের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলো, বিশেষত নালন্দা এবং বিক্রমশিলা বিহার, ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বলে মনে করা হয়। তার শাসনামলে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব কমে যায় এবং ইসলামি শাসনের ভিত রচিত হয়। যদিও নালন্দা বিহারের ধ্বংস নিয়ে কিছু ইতিহাসবিদ দ্বিমত পোষণ করেন, তাদের মতে, এগুলো বখতিয়ারের আক্রমণের আগেই পরিত্যক্ত ছিল বা ধ্বংসের পথে ছিল।

বখতিয়ার খলজির শাসনকাল থেকে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে, যা সুলতানি আমল এবং পরবর্তী মুঘল যুগে আরও বিস্তার লাভ করে। তবে তার সামরিক জীবনের শেষ পর্যায়ে ১২০৬ সালে তিব্বত অভিযান পরিচালনার সময় তিনি ব্যর্থ হন। অভিযানের পর বাংলায় ফিরে আসার পর তাকে হত্যা করা হয়। তার মৃত্যুর পর মুহাম্মদ শিরান খলজি তার স্থলাভিষিক্ত হন। বখতিয়ারের শাসন এবং সামরিক অভিযানের মাধ্যমে বাংলা ও বিহারের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

প্রাথমিক জীবন

বখতিয়ার খলজি, যিনি মালিক গাজি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি নামেও পরিচিত, ছিলেন মুসলিম খলজি উপজাতির একজন বিশিষ্ট সদস্য। খলজি উপজাতি তুর্কিস্তান থেকে আফগানিস্তানে প্রায় দুই শতাব্দী আগে এসে বসতি স্থাপন করে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই উপজাতি সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্বে থাকা শাসকদের সহায়ক হিসেবে পরিচিত ছিল।

তুর্কি বংশোদ্ভূত ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য জানা যায় না। তিনি আফগানিস্তানের গরমশির (বর্তমানে দশতে মার্গ) এলাকার অধিবাসী ছিলেন। দারিদ্র্যের কারণে তিনি স্বদেশ ছেড়ে ভাগ্যান্বেষণে বের হন। গজনির সুলতান মুহাম্মদ ঘুরির সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন। এরপর দিল্লিতে কুতুবুদ্দিন আইবেকের দরবারে গিয়ে চাকরির আবেদন করেন, কিন্তু সেখানেও সফল হননি।

দিল্লিতে ব্যর্থ হওয়ার পর বখতিয়ার বদাউন অঞ্চলে যান। বদাউনের শাসনকর্তা মালিক হিজবর উদ্দিন তাকে নগদ বেতনে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তবে বখতিয়ার উচ্চাভিলাষী প্রকৃতির কারণে এই অবস্থানে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। বদাউন ত্যাগ করে তিনি অযোদ্ধায় পাড়ি জমান। অযোদ্ধার শাসনকর্তা হুসামউদ্দিন তাকে মির্জাপুর জেলার পূর্ব-দক্ষিণ কোণে অবস্থিত ভগবৎ ও ভিউলি নামক দুটি পরগনার জায়গির প্রদান করেন।

এই দুটি পরগনায় থেকে বখতিয়ার তার সামরিক শক্তি সংগঠিত করেন এবং তার ভবিষ্যৎ উন্নতির ভিত্তি গড়ে তোলেন। এই অঞ্চলগুলোই পরবর্তীকালে তার সামরিক অভিযানের শক্তির মূল উৎস হয়ে ওঠে, যা তাকে বাংলার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

অভিযান ও সম্রাজ্য বিস্তার 

১২০১ সালে বখতিয়ার খলজি মাত্র দুই হাজার সৈন্য নিয়ে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে আক্রমণ চালাতে শুরু করেন। তার সাহসিকতা এবং সামরিক দক্ষতার খ্যাতি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, যা তাকে আরও সৈন্য সংগ্রহ করতে সহায়তা করে। ক্রমে তার বাহিনী মুসলিম সৈন্যদের যোগদানে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তিনি একটি প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গের মতো স্থানে পৌঁছান এবং তা আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে তিনি কোনো বড় বাধার মুখোমুখি হননি। দুর্গটি দখল করার পর তিনি সেখানে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখেন—দুর্গের অধিবাসীরা প্রত্যেকেই মুণ্ডিতমস্তক, এবং দুর্গটি বিভিন্ন ধরনের বইপত্রে পূর্ণ।

জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন এটি একটি বৌদ্ধ বিহার, যা ওদন্তপুরী বিহার বা ওদন্ত বিহার নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় থেকেই মুসলিম বিজেতারা স্থানটিকে "বিহার" বা "বিহার শরিফ" নামে ডাকতে শুরু করে।

বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার প্রচুর ধনরত্ন অর্জন করেন এবং সেগুলো নিয়ে দিল্লিতে কুতুবুদ্দীন আইবেকের কাছে যান। সেখানে কুতুবুদ্দীন তাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদান করেন এবং বিজয়ের জন্য তাকে অভিনন্দিত করেন। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বখতিয়ার খলজি বাংলা জয়ের পরিকল্পনা করতে শুরু করেন এবং তার সামরিক শক্তি আরও বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেন। এই সময় থেকেই বাংলার ইতিহাসে তার আরও বড় ভূমিকা পালনের পথ সুগম হয়।

তৎকালীন বাংলার রাজা লক্ষ্মণসেন তার রাজধানী নদিয়ায় অবস্থান করছিলেন, যা বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত বলে বিবেচিত ছিল। কথিত আছে, বখতিয়ার খলজীর আগমনের কিছুদিন আগে রাজসভার কিছু দৈবজ্ঞ পণ্ডিত লক্ষ্মণসেনকে সতর্ক করেছিলেন যে, এক তুর্কি সৈনিক তাকে পরাজিত করতে পারে। এই ভবিষ্যদ্বাণী লক্ষ্মণসেনের মনে ভীতির সঞ্চার করে। তিনি নদিয়ার প্রবেশপথ রাজমহল ও তেলিয়াগড়ের নিরাপত্তা জোরদার করেন এবং ঝাড়খণ্ডের দুর্গম অরণ্যের কারণে নদিয়াকে অপরাজেয় মনে করেন।

তবে বখতিয়ার খলজি তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হন এবং তার গতির জন্য মাত্র ১৭ জন সৈনিকই তাকে অনুসরণ করতে সক্ষম হন। নদিয়ায় পৌঁছে বখতিয়ার সরাসরি রাজা লক্ষ্মণসেনের প্রাসাদে উপস্থিত হন। প্রাসাদের দ্বাররক্ষী ও প্রহরীদের হত্যা করে তিনি প্রাসাদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। এই আকস্মিক আক্রমণে প্রাসাদে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়, আর লক্ষ্মণসেন ভীত হয়ে প্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে নৌপথে বিক্রমপুরে আশ্রয় নেন।

নদিয়া জয়ের পর বখতিয়ার খলজি গৌড়ের দিকে অগ্রসর হন এবং সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। গৌড়, যা পরবর্তীতে লখনৌতি নামে পরিচিত হয়, খলজির শাসনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর পর তিনি বরেন্দ্র তথা উত্তর বাংলায় নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বখতিয়ার তার অধিকারভুক্ত এলাকাগুলোকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেন এবং প্রত্যেকটি প্রদেশে একজন সেনাপতিকে শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। তার সেনাধ্যক্ষদের মধ্যে আলি মর্দান খলজি বরসৌলের শাসনকর্তা এবং হুসামউদ্দিন ইওজ খলজি গঙ্গতরীর শাসক হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিলেন।

বখতিয়ার খলজির রাজ্য পূর্বদিকে তিস্তা ও করতোয়া নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, উত্তরে দিনাজপুরের দেবকোট থেকে রংপুর পর্যন্ত এবং পশ্চিমে পূর্বে বিজিত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে বর্তমান বাংলাদেশের বেশিরভাগ অঞ্চল তখনো তার রাজ্যের বাইরে ছিল। এসব এলাকা দখলের পরিবর্তে তিনি তিব্বত আক্রমণের পরিকল্পনা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল তুর্কিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করা। তিব্বতে পৌঁছানোর পথ নির্ধারণের জন্য তিনি বাংলার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেচ উপজাতির একজন সদস্য আলী মেচকে নিয়োগ দেন।

প্রস্তুতি সম্পন্ন করে বখতিয়ার তিনজন সেনাপতি এবং প্রায় দশ হাজার সৈন্য নিয়ে লখনৌতি থেকে তিব্বতের দিকে রওনা দেন। তাদের যাত্রাপথে বর্ধনকোট শহরের কাছে এসে তারা একটি চওড়া নদী বেগমতীর সম্মুখীন হন। তিন দিন নদীর তীর ধরে অগ্রসর হয়ে তারা একটি পাথরের সেতুর কাছে পৌঁছান। সেতুর সুরক্ষার জন্য তিনি তার দুইজন সেনাপতিকে সেখানে রেখে নিজে সৈন্যবাহিনী নিয়ে সামনে অগ্রসর হন।

সামনে একটি দুর্গে পৌঁছে তিনি তীব্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা দখল করেন, তবে এতে তার সৈন্যবাহিনী গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্গের সৈন্যদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন যে অদূরে করমবত্তন শহরে বিপুলসংখ্যক সৈন্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। এই সংবাদে বখতিয়ার আর সামনে না গিয়ে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। ফেরার পথে তার সৈন্যরা পাহাড়ি পথ এবং প্রতিকূল পরিবেশে প্রচণ্ড কষ্ট সহ্য করে।

সেতুর কাছে ফিরে এসে তিনি দেখতে পান যে পার্বত্য লোকেরা তার দুই সেনাপতিকে হত্যা করে সেতুটি ধ্বংস করে দিয়েছে। ফলে অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে তিনি কোনোভাবে ফিরে আসতে সক্ষম হন। এই অভিযানের ব্যর্থতা বখতিয়ারের সামরিক শক্তিকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করে দেয়। মানসিকভাবে এই পরাজয়ের ভারে তিনি ভেঙে পড়েন, যা তার পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে।

মৃত্যু

তিব্বত অভিযান ব্যর্থ হয়ে বখতিয়ার খলজি দেবকোটে ফিরে আসেন। গৌহাটির কাছাকাছি ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে কানাই বড়শি বোয়া নামক স্থানে তুর্কি সেনাদলের বিধ্বস্ত হওয়ার বিভিন্ন চিহ্ন এখনও পাওয়া যায়। এই ব্যর্থ অভিযানের ফলে লখনৌতির মুসলিম রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। সেনাদলের ব্যাপক ক্ষতি ও সামরিক দুর্বলতার কারণে রাজ্যের প্রজাদের মধ্যে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। একই সঙ্গে দিল্লির সাথে সম্ভাব্য বিরোধের শঙ্কায় বাংলার ছোট ছোট মুসলিম রাজ্যগুলো চাপে পড়ে যায়।

এই পরিস্থিতি এবং পরাজয়ের গ্লানিতে বখতিয়ার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। চিন্তা ও কষ্টে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে, অসুস্থতার মধ্যেই তার মৃত্যু ঘটে। মিনহাজ ই সিরাজের বিবরণ অনুসারে, তিনি তার সেনাপতি আলী মর্দান খলজির হাতে ছুরিকাহত হয়ে প্রাণ হারান। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার নারায়ণপুরের পীরপাল গ্রামে তার সমাধি অবস্থিত বলে জানা যায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post