ওদন্তপুরী (ওদন্তপুর, ওদন্তপুরা, উদ্দন্তপুর, উদন্তপুরা বা উদন্তপুরা নামেও পরিচিত) বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মহাবিহার ছিল। এটি খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে পাল রাজা প্রথম গোপাল পাটলীপুত্র বা বর্তমান পাটনার নিকট প্রতিষ্ঠা করেন। তবে কিছু ইতিহাসবিদ দাবি করেন যে, পাল রাজা ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ) এই বিহারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর, ওদন্তপুরী ছিল মগধ অঞ্চলের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ শিক্ষা কেন্দ্র। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও গবেষণা জন্য নানা বিখ্যাত পণ্ডিতরা শিক্ষা দান করতেন।
এটি প্রায় এক হাজার বছর পর্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ কেন্দ্র ছিল, তবে ১১০০ সালের শেষের দিকে তুর্কি-মুসলিম আক্রমণকারী মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির আক্রমণে বিহারটি ধ্বংস হয়ে যায়। এই আক্রমণের ফলে ওদন্তপুরী মহাবিহার এবং তার আশপাশের এলাকা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়। বর্তমানে ওদন্তপুরী নালন্দা জেলা সদর বিহার শরীফে অবস্থিত, এবং এটি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে।
ইতিহাস
তিব্বতের ২৭তম শাক্য ত্রিজিন জামগন আবে জাব (১৫৯৭–১৬৫৯) রচিত তিব্বতের কালচক্র তন্ত্রে "সেন্ধ-পা"র অধীনে শ্রাবকযান বৌদ্ধবিহার ওদন্তপুরীর উল্লেখ পাওয়া যায়। তিব্বতীয় ইতিহাসবিদ তারানাথের মতে রাজা মহাপাল ওদন্তপুরীতে প্রায় ৫০০ শ্রাবক ভিক্ষুর ভরণপোষণ করতেন। এছাড়া তিনি ওদন্তপুরীর সাথে ৫০০ সেন্ধ-পা বা সেন্ধব শ্রাবকদের জন্য ঊর্বশ বিহার নামক একটি বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। পাল রাজা রামপালের সময় হীনযান ও মহাযান উভয় সম্প্রদায়ের প্রায় সহস্র ভিক্ষু বিহারে থাকতেন। এছাড়া বিহারে ক্ষেত্রবিশেষে কখনো কখনো প্রায় বারো হাজার ভিক্ষুর সমাবেশ ঘটতো। পিটার স্কিলিং-এর মতে সেন্ধ-পা শ্রাবকেরা সম্ভবত সাম্মাতিয়া ছিল। "সেন্ধ-পা" শব্দটি সংস্কৃত "সৈন্ধব" থেকে এসে থাকতে পারে, যার অর্থ হয় সিন্ধুর অধিবাসী। সিন্ধুতে তৎকালে সাম্মাতিয়া বৌদ্ধ বিহারের আধিপত্য ছিল বলে ধারণা করা হয়। তারানাথ সেন্ধ-পা বা সেন্ধব শ্রাবক ভিক্ষুদের বুদ্ধ গয়ার মহাবোধি ও "সিংহ দ্বীপ" বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত করেন।
প্রাচীন বাংলা ও মগধে পাল রাজাদের আমলে বেশ কয়েকটি বৌদ্ধ বিহার গড়ে ওঠে, যার মধ্যে পাঁচটি মহাবিহারের নাম পাওয়া যায়। মহাবিহারগুলো হলো: বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয় (পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাবিদ্যালয়), নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় (পৃথিবীর প্রথম আবাসিক মহাবিদ্যালয়, অতীতে গৌরবোজ্জ্বল এবং বর্তমানেও আলোচিত), সোমপুর মহাবিহার, ওদন্তপুরী এবং জগদ্দল। পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ই পরস্পর সংযুক্ত ছিল, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় রাজাদের তত্ত্বাবধানে ছিল এবং বিহারগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সংযোগ ছিল। পাল সাম্রাজ্যের অধীনে পূর্ব ভারতে প্রতিষ্ঠিত আন্তঃসম্পর্কিত বিহার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একত্রে একটিমাত্র নেটওয়ার্ক হিসেবে বিবেচিত হতো। মহাবিহারগুলোর পণ্ডিতেরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে পারতেন, এমনকি বিখ্যাত পণ্ডিতদের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদবীর ভিত্তিতে স্থানান্তরিত হওয়া সাধারণ ব্যাপার ছিল।
নালন্দার মতো ওদন্তপুরীর প্রথম পর্বের অধিকাংশ আচার্য ও শিক্ষার্থী বাঙালি ছিলেন। বিক্রমশিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য শ্রীগঙ্গাজী ওদন্তপুরীর শিক্ষার্থী ছিলেন। বহু তিব্বতীয় নথি অনুসারে পঞ্চানন নদীর তীরে হিরণ্য প্রভাত পর্বতে অবস্থিত ওদন্তপুরীতে প্রায় ১২,০০০ ছাত্র ছিল।
১১৯৩ সালে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজীর আক্রমণে নালন্দার মতোই ওদন্তপুরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বখতিয়ার খলজী বিহারের বিভিন্ন দুর্গ আক্রমণকালে উঁচু প্রাচীরঘেরা ওদন্তপুরীকে দুর্গ মনে করে এটি আক্রমণ করেন। ভিক্ষুদের মুণ্ডিত মাথা দেখে তিনি তাদের ব্রাহ্মণ মনে করেন এবং ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালান। এ সময় বিহারের আচার্য শাক্যশ্রী ভদ্র এই ধ্বংসযজ্ঞ দেখে জগদ্দল পালিয়ে যান। বখতিয়ারের আক্রমণে ওদন্তপুরী মহাবিহার এবং এর আশেপাশের এলাকা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়, যা বৌদ্ধ শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে তার ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেয়।