নীল বিদ্রোহ ১৮৫৯ সালে বাংলায় সংঘটিত একটি ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ, যা নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানানো কৃষকদের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এবং এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বাংলার কৃষক সমাজের প্রধানরা, যেমন মণ্ডল ও বৃহৎ কৃষকরা। পাশাপাশি, নীলকুঠির প্রাক্তন কর্মচারীরাও, যারা দেওয়ান বা গোমস্তা হিসেবে কাজ করতেন, কৃষকদের সংগঠিত করে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেন। বাংলার কৃষকদের ওপর অর্ধ শতাব্দী ধরে চলা নির্মম নিপীড়ন এবং জোরপূর্বক নীল চাষ করানোর আইন প্রণয়নের ফলে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়।
ভারতের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী হওয়ায় ব্রিটিশ নীলকররা এই ক্ষেত্রে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে। বাংলার নদীয়া, যশোর, বগুড়া এবং রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় নীলচাষ শুরু হয়। উনিশ শতকের শেষদিকে কৃষকদের জন্য নীল চাষ লাভজনক না থাকায় তারা ধান ও পাট চাষে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু ব্রিটিশ নীলকররা অত্যাচার ও নিপীড়নের মাধ্যমে কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করতে চাইলে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এক পর্যায়ে আন্দোলনের সফলতা বাংলায় নীল চাষ পুরোপুরি বিলুপ্ত করে।
প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারভুক্ত ছিল, যা ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের মাধ্যমে লোপ পায়। এর ফলে ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকর বাংলায় এসে নীল চাষ শুরু করে, এবং এই সময় থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার বৃদ্ধি পায়। ১৮৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে কৃষকরা সংগঠিত হয়ে নীল চাষে অস্বীকৃতি জানায়। প্রথমে এই আন্দোলন অহিংস থাকলেও নীলচাষ না করার কারণে চাষিদের ওপর নির্যাতন, গ্রেপ্তার এবং সহিংসতা বাড়তে থাকলে আন্দোলন সশস্ত্র রূপ নেয়। এই বিদ্রোহ বাংলার বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমর্থন পায়, বিশেষত চাঁদপুরের হাজি মোল্লার মতো ব্যক্তিরা নীল চাষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং নীল চাষকে ত্যাগ করার আহ্বান জানান।
নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৮৬০ সালে একটি 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশনের তদন্তে কৃষকদের অভিযোগ যথার্থ প্রমাণিত হয় এবং নীল চাষ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করা হয়। এর ফলে ১৮৬০-৬২ সালের মধ্যে নীল বিদ্রোহের অবসান ঘটে। ১৯০০ সালের মধ্যে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে বাংলায় নীল চাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। নীল বিদ্রোহ বাংলার কৃষক সমাজের ঐক্য ও প্রতিরোধের এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সূচনা হিসেবে গণ্য হয়।
নীলচাষের ইতিহাস ও আধুনিকীকরণ
বাংলায় নীল চাষের প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই ছিল। ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের গ্রন্থ, প্রাচীন প্রতিমূর্তির রঙ, অঙ্কিত পট ও চিত্রে এর উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। নীল ইংরেজিতে indigo নামে এবং গ্রিক ও রোমান ভাষায় indicum নামে পরিচিত, উভয় শব্দই india শব্দের সমার্থক। ধারণা করা হয়, নীলের উৎপত্তি এ দেশেই, কারণ প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার ছিল প্রচলিত। এই গোষ্ঠী সিন্ধু নদীর তীরে বসবাস করত, যা নীল চাষের শিকড় হিসেবে বিবেচিত।
বাংলায় আধুনিক পদ্ধতিতে নীল চাষ ও এর ব্যবহারের প্রচলন ঘটে লুই বোনার্ড নামের এক ফরাসি বণিকের মাধ্যমে। ১৭৭৭ সালে তিনি আমেরিকা থেকে প্রথম নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। একই বছরে তিনি হুগলী নদীর তীরে গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে প্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। এর কয়েক বছর পর মালদহে এবং ১৮১৪ সালে বাকিপুরে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। এরপর যশোরের নহাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা গড়ে ওঠে। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করা হয়, যা ব্রিটেন ও বাকি উপমহাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। একই বছরে লুই বোনার্ডের মৃত্যু হয়, তবে তার অবদান বাংলায় নীল চাষের আধুনিকায়নে স্থায়ী প্রভাব ফেলে।
লুই বোনার্ডের পর ক্যারল ব্লুম নামের এক ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। ১৭৭৮ সালে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষের বিপুল মুনাফার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানিয়ে দ্রুত এই ব্যবসা শুরু করার আহ্বান জানান এবং গভর্নর জেনারেলের কাছে একটি স্মারকপত্র জমা দেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পে ব্যাপক উন্নতি ঘটে, যা নীলের চাহিদা বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। এই সময়ে নীলচাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসায় রূপ নেয়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি লাভের এই সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই নীলের কারবার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। হিসাব অনুযায়ী, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীলচাষে যে খরচ হত, তা কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম সরবরাহ করত। উৎপাদিত নীল পুরোপুরি ইংল্যান্ডে রপ্তানি করা হত, যা থেকে কোম্পানি বিপুল মুনাফা অর্জন করত। ব্যবসার লাভজনকতার কারণে অনেক কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি এবং রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের ব্যবসায় যুক্ত হন। দেশীয় জমিদার ও মহাজনেরাও ব্যক্তিগত বা যৌথভাবে কারবার শুরু করেন। এর ফলে ১৮১৫ সালের মধ্যে নদীয়া, যশোর, খুলনা, ২৪ পরগণা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, নাটোর, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এইসব এলাকার উৎকৃষ্ট মানের নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের নীলের ব্যবসা করে ধনী হয়ে ওঠার গল্প ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ, দিনেমারসহ বিভিন্ন দেশের ধনিকরা বাংলায় পাড়ি জমায়।
নীলচাষের প্রসারে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী এবং উদীয়মান শহুরে শ্রেণীও ভূমিকা রাখে। এদের মধ্যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর এবং রাজা রামমোহন রায় উল্লেখযোগ্য। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে একটি সভা আয়োজন করেন এবং নীলচাষের প্রসার নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। ব্রিটিশ সরকার তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। পাশাপাশি, ব্যাপক নীলচাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যায় রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই লক্ষ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অযোধ্যা দখল করে।
বাংলাদেশে তখনকার সময়ে ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে প্রায় ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানির অধীনে ৬২৮টি সদর নীলকুঠির তত্ত্বাবধানে ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে প্রায় ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক জড়িত ছিল এবং নীলকুঠিগুলোর কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের প্রায় ৭৩ শতাংশ নীলের ব্যবসায় লগ্নিকৃত ছিল। নীল ছিল সে সময়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, যা অন্য কোনো পণ্য এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।