স্বর্ণমান (Gold Standard) কী?

 

স্বর্ণমান হল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে একটি দেশের মুদ্রার মান সরাসরি স্বর্ণের নির্দিষ্ট পরিমাণের সাথে যুক্ত থাকে। সহজ ভাষায়, কোনো দেশের মুদ্রার পেছনে সমপরিমাণ স্বর্ণের মজুদ থাকে, এবং সেই মুদ্রা নির্ধারিত হারে স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্য। এটি একসময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং মুদ্রার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ব্যবহৃত হতো।

স্বর্ণমানের বৈশিষ্ট্য

  1. মুদ্রার মান স্বর্ণে স্থিরকরণ:
    প্রতিটি দেশের মুদ্রার মূল্য একটি নির্দিষ্ট ওজনের স্বর্ণের সমান ছিল। উদাহরণস্বরূপ, যদি এক ডলার = ১০ গ্রাম স্বর্ণ, তবে এই হারে ডলারকে স্বর্ণে রূপান্তর করা যেত।

  2. স্বর্ণের ভিত্তিতে মুদ্রা প্রচলন:
    দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কেবলমাত্র সেই পরিমাণ মুদ্রা ছাপাতে পারত, যা দেশের কাছে থাকা স্বর্ণের মজুদের সমান বা সমর্থনযোগ্য।

  3. স্বর্ণের বিনিময়ের অধিকার:
    যে কেউ তাদের হাতে থাকা মুদ্রা নির্ধারিত হারে স্বর্ণে রূপান্তর করতে পারত। এটি জনগণের মধ্যে মুদ্রার প্রতি আস্থা তৈরি করত।

  4. আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সহজতা:
    বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মূল্যও স্বর্ণের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মুদ্রা বিনিময় সহজ হতো।


স্বর্ণমানের ইতিহাস

স্বর্ণমান বা গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের ইতিহাস মানব সভ্যতার আর্থিক ব্যবস্থার একটি দীর্ঘ ও বিস্তৃত অধ্যায়। স্বর্ণের প্রতি মানুষের আকর্ষণ প্রাচীন কাল থেকেই ছিল, এবং এটি প্রথমদিকে অলঙ্কার ও মূল্যবান সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও পরে এটি অর্থনীতির একটি মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠে। প্রাচীন মিশর, মেসোপটেমিয়া, ভারত ও চীনে স্বর্ণকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ সালে লিডিয়া সভ্যতায় স্বর্ণ ও রূপার মিশ্রণ দিয়ে প্রথম ধাতব মুদ্রা তৈরি করা হয়।

রোমান সাম্রাজ্যে স্বর্ণ একটি কেন্দ্রীয় মুদ্রা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং এর ব্যবহার মধ্যযুগেও অব্যাহত থাকে। তবে, আধুনিক স্বর্ণমানের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৮১৬ সালে, যখন যুক্তরাজ্য প্রথমবারের মতো স্বর্ণমান ব্যবস্থা চালু করে। এই ব্যবস্থায় দেশের মুদ্রার মান একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো। ১৯ শতকের শেষ দিকে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এবং অন্যান্য অঞ্চলে স্বর্ণমান ব্যবস্থা গৃহীত হয়, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা ও বিশ্বাস যোগায়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) এই ব্যবস্থার প্রথম বড় সংকট নিয়ে আসে। যুদ্ধকালীন ব্যয়ের জন্য দেশগুলো স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন স্থগিত করে এবং কাগজ মুদ্রার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে স্বর্ণমান আংশিকভাবে পুনঃপ্রবর্তিত হলেও, ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দা এই ব্যবস্থার স্থিতিশীলতাকে ভেঙে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) পরে ১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস সম্মেলনে একটি নতুন আর্থিক ব্যবস্থা চালু হয়। এতে মার্কিন ডলারকে স্বর্ণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যেখানে প্রতি আউন্স স্বর্ণের মূল্য ছিল ৩৫ ডলার। অন্য দেশগুলো তাদের মুদ্রাকে ডলারের সঙ্গে যুক্ত রাখে। এটি কার্যত স্বর্ণমানের একটি পরোক্ষ রূপ হলেও ১৯৭১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যবস্থা বাতিল করে, কারণ দেশটির অর্থনীতি স্বর্ণের মজুদের সঙ্গে মুদ্রার সমতা রক্ষা করতে পারছিল না।  স্বর্ণমান ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল যে ৩৫ ডলারে ১ আউন্স স্বর্ণ পাওয়া যাবে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বব্যাপী ডলারের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়, কারণ ডলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রা হয়ে ওঠে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রচুর পরিমাণে ডলার ছাপাতে থাকে। কিন্তু মার্কিন স্বর্ণমজুদের পরিমাণ এই ডলারের সমানুপাতিক ছিল না। ফলে স্বর্ণের সঙ্গে ডলারের সমতা ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠে।

১৯৪৪ সালের ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে মার্কিন ডলারকে স্বর্ণের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয় এবং অন্যান্য দেশের মুদ্রা ডলারের ওপর নির্ভর করে। এই ব্যবস্থা কিছু সময় কার্যকর থাকলেও, ১৯৬০-এর দশকে ইউরোপ ও জাপান অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা মার্কিন ডলার ধরে রাখতে আগ্রহ হারায় এবং ডলার বদলে স্বর্ণ দাবি করতে থাকে। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণমজুদ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৬০ এবং ১৯৭০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ সামাজিক কর্মসূচির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি বেড়ে যায়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্র বড় আকারের ঘাটতিতে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ডলারের মান কমে যেতে থাকে। 

স্বর্ণমান ব্যবস্থায় মুদ্রার মান স্থির রাখতে হয়, যা অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন করে তোলে। মার্কিন অর্থনীতি মুদ্রার স্থির মান বজায় রেখে মূল্যস্ফীতি ও মন্দার মতো সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারছিল না। ১৯৭১ সালের আগস্টে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন স্বর্ণমান বাতিলের ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে ডলার আর স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্য থাকল না। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং মার্কিন অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য। এই ঘটনা "নিক্সন শক" নামে পরিচিত।

এরপর থেকে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থা ভাসমান বিনিময় হার ব্যবস্থায় চলে আসে। যদিও স্বর্ণমান প্রত্যাখ্যাত, স্বর্ণ এখনও বিনিয়োগ ও মূল্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এটি আর্থিক বাজারে স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

বর্তমানে, স্বর্ণ একটি রিজার্ভ সম্পদ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোতে সংরক্ষিত হয় এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনে এর কৌশলগত ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে। স্বর্ণমানের ইতিহাস মানব সভ্যতার আর্থিক প্রবৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি যুগান্তকারী অধ্যায়।

স্বর্ণমানের সুবিধা - অসুবিধা

স্বর্ণমানের (Gold Standard) প্রধান সুবিধা হলো এটি মুদ্রার মান নির্ধারণে স্থিতিশীলতা আনে, কারণ মুদ্রার মূল্য নির্দিষ্ট পরিমাণ স্বর্ণের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এর ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয় এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আস্থা বৃদ্ধি পায়। স্বর্ণমান ব্যবস্থায় মুদ্রার অতিরিক্ত সরবরাহ সম্ভব নয়, যা অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে। তবে, এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অসুবিধাও রয়েছে। স্বর্ণমানের কারণে একটি দেশের অর্থনীতি স্বর্ণের মজুদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা অর্থনৈতিক সংকটের সময় সীমিত নীতিগত বিকল্প রাখে। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সীমিত করতে পারে এবং মন্দার সময় আর্থিক স্থিতিশীলতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া, স্বর্ণমান ব্যবস্থায় মুদ্রানীতি নমনীয় নয়, ফলে অর্থনীতির পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ঘাটতি বা উদ্বৃত্তের কারণে দেশগুলো স্বর্ণ হারানোর ঝুঁকিতে পড়ে, যা অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে।

স্বর্ণমানের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে কোনো দেশেই স্বর্ণমান ব্যবস্থার প্রচলন নেই। আজকের অর্থনীতি পুরোপুরি ফিয়াট মুদ্রা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল, যেখানে মুদ্রার মূল্য সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্বাস ও পরিচালনার ওপর নির্ভর করে। তবে কিছু দেশ তাদের মুদ্রার মানকে স্বর্ণের সাথে আংশিকভাবে যুক্ত রাখার চেষ্টা করে।

উপসংহার:
স্বর্ণমান একটি ঐতিহাসিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। তবে এর সীমাবদ্ধতাগুলো আধুনিক অর্থনীতির চাহিদার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এটি পরিত্যক্ত হয়েছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post