মহাযান বৌদ্ধধর্ম: ইতিহাস ও বৈশিষ্ট্য

মহাযান (সংস্কৃত: महायान, অর্থাৎ "মহৎ পথ") বৌদ্ধধর্মের প্রধান দুটি শাখার একটি, অপরটি হল থেরবাদ। এটি মূলত বৌদ্ধ দর্শন এবং আধ্যাত্মিক অনুশীলনের একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, যা ব্যক্তিগত মুক্তি নয় বরং সমস্ত জীবের মুক্তির জন্য উৎসর্গীকৃত। মহাযানের মূল ভাবনা বোধিসত্ত্বের আদর্শকে ঘিরে গড়ে উঠেছে।

ইতিহাস ও প্রাথমিক বিকাশ

মহাযানের উদ্ভব খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে ভারতে। এটি একটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় হিসেবে শুরু হয় এবং পরবর্তীকালে নালন্দার মতো মহাযান শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমে ঐতিহাসিক গুরুত্ব অর্জন করে। মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রাথমিক গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে সদ্ধর্ম পুণ্ডরিকা সূত্র, যা বোধিসত্ত্বের পথের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে।

মহাযান শিক্ষাগুলি চীনের মাধ্যমে পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ৭ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে এটি তিব্বত, মঙ্গোলিয়া এবং কোরিয়াতেও প্রভাব বিস্তার করে।

মতাদর্শ ও বোধিসত্ত্বের পথ

মহাযানের মূল লক্ষ্য হল সম্যকসম্বুদ্ধ বা পূর্ণ জ্ঞান অর্জন, যা একটি বোধিসত্ত্বের আদর্শ। এটি অনুসারীদের চেতনার উন্নতি ও সকল জীবের মুক্তির জন্য কাজ করার উপর জোর দেয়। মহাযানপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে বোধিলাভ একক জীবনেই সম্ভব এবং এটি কেবলমাত্র ভিক্ষু বা সন্ন্যাসীদের জন্য সীমাবদ্ধ নয়।

বোধিসত্ত্বযান নামে পরিচিত এই পথ মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ ও মহাজ্ঞান অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে।

বর্তমান মহাযানের অনুশীলন

মহাযান বর্তমানে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ব্যাপকভাবে অনুশীলিত হয়। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রায় ৫৩% মহাযানপন্থী। এই শাখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:

  • চান/জেন বৌদ্ধধর্ম: এটি চীন ও জাপানে ব্যাপকভাবে অনুশীলিত।
  • তিয়ান্তাই ও শিংগন বৌদ্ধধর্ম: মূলত পূর্ব এশিয়ায় প্রচলিত।
  • বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম: এটি মহাযানের একটি শাখা বা পৃথক মত বলে বিবেচিত হয়। তিব্বত ও মঙ্গোলিয়ায় এর প্রসার লক্ষ্যণীয়।

মহাযানের বৈশিষ্ট্য

১. সহানুভূতি ও কল্যাণ: সকল প্রাণীর মুক্তির জন্য কাজ করা।
২. সূত্র ও গ্রন্থসমূহ: সদ্ধর্ম পুণ্ডরিকা সূত্র, অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা ইত্যাদি।
৩. সাধনা পদ্ধতি: ধ্যান, বোধিচিত্ত জাগরণ এবং পারমিতা (সম্পূর্ণতা) চর্চা।

উপসংহার

মহাযান বৌদ্ধধর্ম কেবল আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য নয়, মানবকল্যাণের জন্য এক নিরলস প্রচেষ্টা। এটি চেতনার উন্নতির মাধ্যমে মানবজীবনে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং সামগ্রিক মুক্তির জন্য একটি মহৎ পথ নির্দেশ করে। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে মহাযান তার আদর্শ, বৈচিত্র্য এবং মানবকল্যাণের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

Post a Comment

Previous Post Next Post