বৌদ্ধ ধর্ম

 বৌদ্ধ ধর্ম হল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্ম, যা আনুমানিক ২৫০০ বছর আগে ভারতবর্ষে উদ্ভূত হয়েছিল। এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিদ্ধার্থ গৌতম, যিনি পরবর্তীতে "গৌতম বুদ্ধ" নামে পরিচিত হন। বুদ্ধ শব্দের অর্থ "যিনি জ্ঞান লাভ করেছেন"। বৌদ্ধ ধর্ম তার সরলতা, দর্শন এবং মানবিকতায় অন্য ধর্মগুলোর থেকে আলাদা।

বৌদ্ধধর্ম হলো পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম ধর্ম, যার অনুসারীর সংখ্যা আনুমানিক ৫২০ মিলিয়ন বা বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৭ শতাংশের বেশি। বৌদ্ধধর্মের অনুসারীদের "বৌদ্ধ" বলা হয়, এবং তারা প্রধানত গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও দর্শনের উপর ভিত্তি করে তাদের বিশ্বাস এবং আধ্যাত্মিক চর্চা পরিচালনা করেন।বৌদ্ধধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ থেকে ৪র্থ শতাব্দীর মধ্যে প্রাচীন ভারতে, একটি শ্রমণ ঐতিহ্য হিসেবে। শ্রমণ ঐতিহ্য হলো এমন একটি আন্দোলন যা বৈদিক ধর্মের প্রথাগত বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠানের বাইরে মানব জীবনের দুঃখ এবং তার সমাধানের উপর আলোকপাত করেছিল। গৌতম বুদ্ধ (সিদ্ধার্থ গৌতম) ছিলেন এর প্রধান প্রবর্তক, যিনি আত্মজ্ঞান লাভের মাধ্যমে এই নতুন ধর্মীয় দর্শন ও নৈতিক পথ তৈরি করেন।

বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য হলো তৃষ্ণা, আসক্তি এবং অবিদ্যার কারণে সৃষ্ট দুঃখ দূর করা, যা বুদ্ধের চার আর্যসত্যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অধিকাংশ বৌদ্ধ ঐতিহ্য নির্বাণ অর্জনের মাধ্যমে বা বোধিসত্ত্বের পথ অনুসরণ করে পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি পাওয়ার ওপর জোর দেয়। যদিও বৌদ্ধ চিন্তাধারায় মুক্তিলাভের পথ, ধর্মগ্রন্থের গুরুত্ব, এবং নির্দিষ্ট শিক্ষা ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে, তবু প্রধান অনুশীলনগুলো হলো বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের শরণ নেওয়া, নৈতিকতা, ধ্যান, এবং পারমিতার চর্চা। থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে প্রচলিত। মহাযান বৌদ্ধধর্ম—পুণ্যভূমি, জেন, নিচিরেন, শিঙ্গোন ও তিয়ান্তাই ঐতিহ্যসহ—পূর্ব এশিয়ায় জনপ্রিয়, এবং বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম, যা ভারতীয় তন্ত্রসাধনা থেকে উদ্ভূত, তিব্বতি সংস্কৃতিতে হিমালয় অঞ্চল, মঙ্গোলিয়া এবং কালমিকিয়াতে প্রচলিত।

বুদ্ধ এবং বুদ্ধত্ব

আক্ষরিক অর্থে "বুদ্ধ" বলতে বোঝায় এমন একজন ব্যক্তি যিনি জ্ঞানপ্রাপ্ত, জাগ্রত এবং উদ্বোধিত। বুদ্ধের আধ্যাত্মিক উপলব্ধি এবং চূড়ান্ত জ্ঞানকে বলা হয় বোধি, যা অর্জিত হয় গভীর তপস্যার মাধ্যমে। সিদ্ধার্থ গৌতম এই কালের একজন জ্ঞানপ্রাপ্ত বুদ্ধ, যিনি বোধি বৃক্ষের নিচে ধ্যান করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বোধিসত্ত্ব হলো বুদ্ধত্ব অর্জনের পূর্ববর্তী জীবন, যেখানে তিনি অসংখ্য জন্মে পরম পুণ্যের কাজ করেন। ত্রিপিটকে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি বোধিসত্ত্ব হিসেবে ৫৪৭ থেকে ৫৫০ বার জন্মগ্রহণ করেছেন। তার প্রতিটি জন্মই ছিলো বুদ্ধত্ব অর্জনের জন্য প্রস্তুতির অংশ। শেষ জন্মে সিদ্ধার্থ গৌতম তার জীবনের লক্ষ্য পূরণ করেন এবং বুদ্ধত্ব লাভ করেন। বুদ্ধ হওয়ার পর, তিনি আর এই দুঃখময় সংসারে জন্ম নেবেন না, এটি ছিলো তার শেষ জন্ম। পৃথিবীতে পরবর্তী মৈত্রেয় বুদ্ধের আবির্ভাব পর্যন্ত তার শিক্ষা ও শাসন চলতে থাকবে।

বৈচিত্র্যময় ঐতিহ্য ও শাখা

বৌদ্ধধর্মের বিশ্বাস এবং আচারগুলো বুদ্ধের মৌলিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তবে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান শাখা পণ্ডিতদের দ্বারা স্বীকৃত:

  1. থেরবাদ (Theravāda):

    • এটি বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনতম শাখা এবং "প্রাচীনদের পথ" হিসেবে পরিচিত।
    • থেরবাদ মূলত শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, এবং কম্বোডিয়ায় প্রচলিত।
  2. মহাযান (Mahāyāna):

    • মহাযান অর্থ "মহান যান"। এটি বৌদ্ধধর্মের একটি উদার শাখা, যেখানে অনেক আধ্যাত্মিক উপায়ের চর্চা করা হয়।
    • এটি প্রধানত চীন, জাপান, কোরিয়া এবং ভিয়েতনামে প্রচলিত।
  3. বজ্রযান (Vajrayāna):

    • বজ্রযান অর্থ "বজ্রের যান"। এটি তন্ত্র চর্চার উপর ভিত্তি করে গঠিত একটি শাখা।
    • এটি মূলত তিব্বত, মঙ্গোলিয়া এবং হিমালয় অঞ্চলে প্রচলিত।

বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস

গৌতম বুদ্ধের জন্ম আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৩ সালে লুম্বিনী (বর্তমান নেপাল) নামক স্থানে। তিনি শাক্য রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার পিতার নাম ছিল শুদ্ধোধন এবং মাতা মায়াদেবী । বুদ্ধের শৈশব কেটেছিল বিলাসবহুল পরিবেশে। তবে জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব ও দুঃখ-দুর্দশা দেখে তিনি রাজকীয় জীবন ত্যাগ করে এক সাধকের পথ গ্রহণ করেন।

৬ বছর সাধনার পর বোধগয়ার বোধি বৃক্ষের নিচে ধ্যান করে তিনি আত্মজ্ঞান লাভ করেন। আত্মজ্ঞান লাভের পর তিনি "মধ্যমার্গ" বা "মধ্যপথ"-এর দর্শন প্রচার করতে শুরু করেন, যা অতিরিক্ত ভোগ বা কঠোর তপস্যার পরিবর্তে মধ্যপন্থার উপর জোর দেয়।

বৌদ্ধ ধর্মের মূলনীতি

বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি হল "চতুরার্য সত্য" এবং "অষ্টমার্গ":

  1. চতুরার্য সত্য:

    • দুঃখ: জীবনে দুঃখ অপরিহার্য।
    • দুঃখের কারণ: কামনা-বাসনা থেকে দুঃখের উদ্ভব।
    • দুঃখের নিবারণ: কামনা দমন করে দুঃখ দূর করা যায়।
    • দুঃখ নিবারণের পথ: অষ্টমার্গ অনুসরণ।
  2. অষ্টমার্গ বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যা জীবনের দুঃখ দূর করার পথ দেখায়। এটি বুদ্ধের শিক্ষার মূল ভিত্তি, এবং "চতুরার্য সত্য"-এর চতুর্থ সত্যের অন্তর্ভুক্ত। অষ্টমার্গ আটটি নীতির সমন্বয়ে গঠিত, যা মানুষকে সঠিক জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়। এগুলোকে মধ্যমার্গ বা "মধ্যপথ" বলা হয়, কারণ এটি চরম ভোগ বা চরম ত্যাগ উভয়কেই বর্জন করে।

    অষ্টমার্গের আটটি উপাদান:

    1. সম্যক দর্শন (সঠিক দৃষ্টি)
      জীবন ও দুঃখ সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি। এটি চতুরার্য সত্যকে বোঝার এবং গ্রহণ করার উপর জোর দেয়।

    2. সম্যক সংকল্প (সঠিক সংকল্প)
      জীবনে সৎ উদ্দেশ্য ও চিন্তা ধারণ করা, যেমন অহিংসা, করুণা, এবং ত্যাগের মনোভাব।

    3. সম্যক বাক্য (সঠিক বাক্য)
      সত্যবাদিতা, পরনিন্দা থেকে বিরত থাকা এবং অন্যকে আঘাত না করার জন্য সঠিক কথা বলা।

    4. সম্যক কর্ম (সঠিক কাজ)
      নৈতিকভাবে সঠিক কাজ করা, যেমন হত্যা, চুরি এবং অনৈতিক কাজ থেকে বিরত থাকা।

    5. সম্যক আজীবিকা (সঠিক জীবিকা)
      জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সৎপথ অবলম্বন করা এবং এমন কাজ করা যা অন্যের ক্ষতি না করে।

    6. সম্যক ব্যায়াম (সঠিক প্রচেষ্টা)
      জীবনে ইতিবাচক গুণাবলীর চর্চা করা এবং নেতিবাচক চিন্তা বা আচরণ পরিহার করার প্রচেষ্টা চালানো।

    7. সম্যক স্মৃতি (সঠিক মনোযোগ)
      নিজের চিন্তা, কাজ, এবং অনুভূতির প্রতি সজাগ থাকা, যেন জীবন সঠিক পথে পরিচালিত হয়।

    8. সম্যক সামাধি (সঠিক ধ্যান)
      ধ্যানের মাধ্যমে মনকে কেন্দ্রীভূত এবং প্রশান্ত করা, যাতে আত্মজ্ঞান লাভ করা যায়।

বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার

বৌদ্ধ ধর্ম প্রথমে ভারতবর্ষে প্রচলিত হয়েছিল। পরে এটি মগধের রাজা অশোকের শাসনকালে ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। রাজা অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে এটি শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ায় ছড়িয়ে দেন।

বর্তমান বৌদ্ধ ধর্ম

আজ বৌদ্ধ ধর্ম সারা বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে শান্তি ও মানবিকতার বার্তা নিয়ে বিরাজ করছে। এটি দক্ষিণ এশিয়া, পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অনুশীলন করা হয়। বৌদ্ধ ধর্ম শুধু একটি ধর্ম নয়, এটি মানবিকতার একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা দুঃখমুক্ত জীবনযাপনের পথ নির্দেশ করে।

উপসংহার
বৌদ্ধ ধর্ম মানব জাতির জন্য শুধু আধ্যাত্মিক পথ নয়, এটি এক ধরনের জীবনধারা। গৌতম বুদ্ধের বাণী আজও বিশ্বজুড়ে মানুষকে দুঃখ ও অসন্তোষের মধ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ দেখায়।

Post a Comment

Previous Post Next Post