মুহাম্মদ (স.) (Hazrat Muhammad)

 মুহাম্মদ ((স.) (Hazrat Muhammad)/; আরবি: مُحَمَّد,.'প্রশংসনীয়'; (৫৭০ - ৮ জুন ৬৩২)ছিলেন একজন সামাজিক এবং রাজনৈতিক আরাব নেতা এবং ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা। ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী তাঁকে নবীদের সীলমোহর বা সর্বশেষ নবী বলে বিশ্বাস করা হয়। কুরআনের পাশাপাশি তার শিক্ষা এবং আদর্শ ইসলামের ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করে।

মুহাম্মদ (স.) আনুমানিক ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আবদুল্লাহ ইবনে আবদ আল-মুত্তালিব এবং আমিনা বিনতে ওয়াহবের পুত্র। তার পিতা আবদুল্লাহ, কুরাইশ উপজাতি নেতা আবদ আল-মুত্তালিব ইবনে হাশিমের পুত্র যিনি মুহাম্মদের (স.) জন্মের সময় মারা যান। তাঁর বয়স যখন ছয় বছর তখন তাঁর মা আমিনাও মারা যান। তিনি তার পিতামহ আবদ আল-মুত্তালিব এবং চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। পরবর্তীতে, প্রার্থনার জন্য তিনি হিরা নামে একটি পাহাড়ের গুহায় বেশ কয়েকটি রাতে নির্জনে অবস্থান করেন। আনুমানিক প্রায় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে যখন তাঁর বয়স প্রায় ৪০ বছর, মুহাম্মদ (স.) গুহায় জিবরাঈল ফেরেশতার সাক্ষাতের কথা জানান এবং ঈশ্বরের কাছ থেকে নবুয়্যত প্রাপ্তির কথা প্রকাশ করেন। ৬১৩ সাল থেকে, তিনি প্রকাশ্যে এই ধর্মের বানী প্রচার করা শুরু করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে "ঈশ্বর এক", ইসলাম ঈশ্বরের (আল্লাহ) সঠিক জীবন পদ্ধতি (দীন), এবং তিনি ইসলামের অন্যান্য নবীদের মতন একজন নবী ও রসূল।

প্রথমদিকে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা কম ছিল এবং ১৩ বছর ধরে মক্কার মুশরিকদের শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের স্বীকার হতে হয়েছিলো। চলমান নিপীড়ন থেকে বাঁচতে, তিনি ৬১৫ সালে  তার কিছু অনুসারীকে আবিসিনিয়ায় পাঠান, এবং ৬২২ সালে  তিনি ও তার অনুসারীরা মক্কা থেকে মদিনায় (তখন ইয়াথ্রিব নামে পরিচিত) চলে যান। এই ঘটনা, হিজরত নামে পরিচিত যা ইসলামী ক্যালেন্ডারের সূচনা করে যেটি হিজরি ক্যালেন্ডার নামেও পরিচিত। মদিনায়, মুহাম্মদ (স.) মদিনার সংবিধানের অধীনে উপজাতিদের একত্রিত করেছিলেন। ৬২৯ সালের ডিসেম্বরে, মক্কার মুহাম্মদ (স.) ১০,০০০ মুসলিম ধর্মান্তরিতদের একটি সৈন্য সংগ্রহ করে মক্কা শহরের দিকে অগ্রসর হন। অনেকাংশে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়  পেয়ে শহরটি দখল করেন। ৬৩২ সালে, বিদায়ী তীর্থযাত্রা থেকে ফিরে আসার কয়েক মাস পরে, তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। তার মৃত্যুর সময়, আরব উপদ্বীপের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করেছিল। 

মুহাম্মাদ (স.) তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে প্রত্যাদেশ (আয়াত) পেয়েছিলেন তা কুরআনের আয়াত হিসেবে পরিচিত। কুরআন ছাড়াও, মুহাম্মদের (স.) শিক্ষা ও অনুশীলন (যা হাদিস নামে পরিচিত) এবং তার জীবনীতে (সীরাহ) প্রাপ্ত ঘটনাবলী, ইসলামিক আইনের উৎস হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।

জীবনী সূত্র

কুরআন ইসলামের মূল ধর্মীয় গ্রন্থ। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে এটি ঈশ্বরের বাণীকে প্রতিনিধিত্ব করে যা প্রধান দূত জিবরাঈল দ্বারা মুহাম্মদের (স.) কাছে আগমন করে কুরআনে বেশ কয়েকটি আয়াতে মুহাম্মদকে (স.)  "ঈশ্বরের বার্তাবাহক" হিসাবে সম্বোধন করা হয়েছে। কুরআনে  কুরাইশদের দ্বারা বিতাড়িত হওয়ার পর ইয়াথ্রিবে তার অনুসারীদের বসতি স্থাপনের  এবং সংক্ষিপ্তভাবে বদরে মুসলিম বিজয়ের মতো সামরিক সংঘর্ষের কথা উল্লেখ আছে। তবে অধিকাংশ কুরআনের আয়াত উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সময়রেখা প্রদান করে না। কুরআনে মুহাম্মদের (স.) কোনো সঙ্গীর নাম উল্লেখ করা হয়নি কুরআনকে মুহাম্মদের (স.) সমসাময়িক বলে মনে করা হয়, এবং বার্মিংহামের পাণ্ডুলিপিটি তার জীবদ্দশায় রেডিওকার্বন করা হয়েছে।

হিজরি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীর লেখকদের ঐতিহাসিক রচনায় মুহাম্মদের (স.) জীবন সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাওয়া যায়।

প্রাচীনতম লিখিত সিরাত হল ইবনে ইসহাকের 'লাইফ অফ গড'স মেসেঞ্জার' যা ৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে (১৫০ হিজরি) লিখিত। যদিও মূল কাজটি হারিয়ে গেছে, এই সিরাটি ইবনে হিশামের রচনা এবং আল-তাবারির আংশিক উদৃতি হিসেবে টিকে আছে। ইবনে হিশাম তার মুহাম্মদের (স.) জীবনীর ভূমিকায় লিখেছেন যে তিনি ইবনে ইসহাকের জীবনী থেকে এমন বিষয়গুলি বাদ দিয়েছেন যা কিছু লোককে কষ্ট দেবে। আরেকটি প্রাথমিক ঐতিহাসিক উৎস হল আল-ওয়াকিদি (মৃত্যু-২০৭ হিঃ) দ্বারা মুহাম্মদের (স.) প্রচারণার ইতিহাস।

প্রাথমিক জীবনী

মুহাম্মদ (স.) ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবদ আল-মুত্তালিব ইবনে হাশিম প্রায় ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মদিন রবি'আল-আউয়াল মাসে বলে মনে করা হয়। তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু হাশিম গোত্রে জন্মেছিলেন, যেটি পশ্চিম আরবের একটি প্রভাবশালী শক্তি ছিল।  তিনি ইব্রাহামের (আ.) পুত্র ইসমাইলের বংশধর ছিলেন বলেও দাবি করা হয়।

আরবি মুহাম্মদ (مُحَمَّد) নামের অর্থ "প্রশংসনীয়" এবং এটি কুরআনে চারবার এসেছে। যৌবনে তিনি আল-আমিন নামেও পরিচিত ছিলেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে তার সততার জন্য এটি  তথকালিন আরবদের দেয়ে নাম ছিলো। আবার অনেকে মনে করেন  এটি  তার মায়ের নাম "আমিনা" এর সাথে মিলিয়ে তার পিতামাতার দেওয়া একটি নাম ছিল মুহাম্মদ (স.) তার পুত্র কাসিমের জন্মের পর আবু আল-কাসিমের কুনিয়া নাম লাভ করেন। তবে মুহাম্মদ (স.) তার পুত্র কাসিম জন্মের মাত্র দুই বছর পর মারা যান।

ইসলামিক ঐতিহ্য বলে যে মুহাম্মদের (স.) জন্ম সালটি হাতির বছরের সাথে মিলে যায়, যখন আবরাহা, (প্রাক্তন হিমিয়ার রাজ্যের আকসুমাইট ভাইসরয়) মক্কা জয় করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা এই ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করে। মুসলিম পণ্ডিতরা সম্ভবতঃ কুরআনের ১০৫:১-৫ - "হাতির মানুষ" সম্পর্কে অস্পষ্ট অনুচ্ছেদটি ব্যাখ্যা করার জন্য মুহাম্মদের (স.) জন্মের বর্ণনার সাথে আবরাহার বিখ্যাত নামটিকে সংযুক্ত করেছেন। অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অফ লেট অ্যান্টিকুইটি আব্রাহার যুদ্ধের হাতি অভিযানের কাহিনীকে একটি মিথ বলে মনে করে।

মুহাম্মদের (স.) পিতা আবদুল্লাহ তার জন্মের প্রায় ছয় মাস আগে মারা যান। এরপর মুহাম্মদ (স.) দুই বছর তার পালক-মা হালিমাহ বিনতে আবি ধুয়েব এবং তার স্বামীর সাথে ছিলেন। ছয় বছর বয়সে, মুহম্মদ অসুস্থতার জন্য তার মা আমিনাকে হারান এবং অনাথ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে  তার বয়স আট বছর না হওয়া পর্যন্ত, মুহাম্মদ (স.) তার পিতামহ আবদ আল-মুত্তালিবের অভিভাবকত্বে ছিলেন। পিতামহের মৃত্যুর পর তিনি বনু হাশিমের নতুন নেতা চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে আসেন। আবু তালিবের ভাইয়েরা মুহাম্মদের (স.) শিক্ষায় সহায়তা করেছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ চাচা হামজা, মুহাম্মদকে (স.) তীরন্দাজ, তলোয়ার চালনা এবং মার্শাল আর্টে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আরেক চাচা, আব্বাস, মুহাম্মদকে সিরিয়ার রুটের উত্তর অংশে কাফেলার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি কাজ দিয়েছিলেন।

 মুহাম্মদের (স.) প্রারম্ভিক জীবনের মক্কার ঐতিহাসিক রেকর্ড সীমিত এবং খণ্ডিত, যা সত্য এবং কিংবদন্তির মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন করে তোলে। বেশ কিছু ইসলামিক ঐতিহাসিক বর্ণনা করে যে, শৈশবে মুহাম্মদ, (স.) তার চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়ায় বাণিজ্য সফরে গিয়েছিলেন এবং বাহিরা নামক এক সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করেছিলেন, যিনি তখন তার নবুওয়াত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বলে কথিত আছে।

মুহাম্মদ (স.) তার চাচাতো বোন ফাখিতা বিনতে আবি তালিবকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু সম্ভবত তার দারিদ্র্যের কারণে, তার প্রস্তাবটি তার পিতা আবু তালিব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন মুহাম্মদের (স.) বয়স যখন ২৫, তখন তার ভাগ্য ঘুরে যায়; তার ব্যবসায়িক খ্যাতি তার ৪০ বছর বয়সী দূরবর্তী আত্মীয় খাদিজার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।  খাদিজা একজন ধনী ব্যবসায়ী মহিলা যিনি ক্যারাভান ট্রেড ইন্ডাস্ট্রিতে একজন বণিক হিসাবে একটি সফল ক্যারিয়ার তৈরি করেছিলেন। তিনি তাকে তার একটি কাফেলাকে সিরিয়ায় নিয়ে যেতে বলেন, এরপর অভিযানে তার দক্ষতা দেখে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে তিনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন; মুহাম্মদ (স.) তার প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সাথেই  ছিলেন।

নবুয়ত লাভ

হজরত মুহাম্মদ (সা.) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর নবুয়ত লাভ করেন। ৪০ বছর বয়সে তিনি অধিকাংশ সময় গুহায় বসে চিন্তা-ভাবনা করতেন। বিশেষত হিরা গুহায়, যা মক্কার নিকটবর্তী একটি পাহাড়ে অবস্থিত। এখানে তিনি একাকী সময় কাটাতেন এবং আল্লাহর সৃষ্টির ভাবনা করতেন।

৬১০ খ্রিষ্টাব্দের রমজান মাসের শেষ দশদিনের কোন এক বিজোড় রাত্রিতে, গুহায় অবস্থানকালে জিবরাইল (আ.) তাঁর কাছে আসেন এবং বলেন, "পড়ো" (ইকরা)। এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম ওহী। হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রথমে এই অভিজ্ঞতা নিয়ে অত্যন্ত চিন্তিত ও ভীত হয়ে পরেন। তবে, তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা.) এবং প্রিয় বন্ধু আবু বকর (রা.) তাঁকে সমর্থন প্রদান করেন। ধীরে ধীরে, তিনি নবী হিসেবে জনগণের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছে দিতে শুরু করেন। 

হিজরত

ইসলামের প্রচার শুরু হলে মক্কার কুরাইশ গোত্রের নেতারা হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে শুরু করেন। তাঁকে অত্যাচার, নির্যাতন ও সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। কিন্তু তিনি ইসলাম প্রচারের কাজ চালিয়ে যান। মক্কার কুরাইশ গোত্র মুসলমানদের সামাজিকভাবে বয়কট করে। তারা মুসলমানদের সঙ্গে বাণিজ্য, যোগাযোগ এবং সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়। এর ফলে মুসলমানদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে। মক্কায় মুসলমানদের নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। তাঁদের জীবন ও সম্পত্তি নিরাপদ ছিলনা, এবং বহু মুসলমান নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন।

আরব উপদ্বীপের বহু মানুষ ইসলামের নতুন ধর্ম এবং তার নবী সম্পর্কে জানত, এবং ব্যবসা বা কাবায় তীর্থের উদ্দেশ্যে মক্কা ভ্রমণ করত। প্রথমবার মক্কায় আসা প্রায় ১২ জন (আকাবার প্রথম শপথ) এবং পরবর্তীতে আবার মক্কায় আসা প্রায় ৩০০ জন (আকাবার দ্বিতীয় শপথ); ৬২০-৬২১ সালে, মক্কা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে 'আকাবা' নামক স্থানে, মুহাম্মাদ তার সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করে ইসলাম গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাকে ইয়াসরিবে (যা পরবর্তীতে মদিনা নামে পরিচিত) আমন্ত্রণ জানানো হয়। মুহাম্মাদ এই সুযোগটি ব্যবহার করে নিজে এবং তার অনুসারীদের জন্য নতুন আশ্রয় খুঁজে পেতে সিদ্ধান্ত নেন। ইয়াসরিবের (মদিনা) আরব জনগণ এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিল, কারণ সেখানে একটি ইহুদি সম্প্রদায় ছিল। তাছাড়া, ইয়াসরিবের জনগণ মুহাম্মাদ এবং ইসলামের মাধ্যমে মক্কায় তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দেখেছিল, কারণ মক্কার তীর্থস্থান হওয়ার ফলে শহরের গুরুত্ব ছিল এবং ইয়াসরিববাসী মক্কার এই গুরুত্বের প্রতি ঈর্ষা করত।

আকাবায় শপথ গ্রহণের পর, মুহাম্মাদ (স.) ইয়াসরিবকে উপযুক্ত আশ্রয় হিসেবে দেখে তার অনুসারীদের সেখানে হিজরত করতে নির্দেশ দেন। পূর্বে হাবশায় যে হিজরত হয়েছিল, তেমনই কুরাইশরা এই হিজরত বন্ধ করার চেষ্টা করবে, তবে অধিকাংশ মুসলিম হিজরত করতে সক্ষম হয়। এমতাবস্থায় তিনি সঙ্গিদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনার আনসাররা ইসলাম গ্রহণ করে এবং নবীকে মদিনায় স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়। তারা নবীর প্রতি তাদের সমর্থন ও সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। মদিনায় হিজরত করার ফলে নবী (সা.) একটি রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। সেখানে তিনি একটি শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে ইসলামের বিস্তার এবং প্রচারের জন্য একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। মদিনায় পৌঁছানোর পর, হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলাম ধর্মের প্রচার এবং শিক্ষার কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করেন।

যুদ্ধ ও সংগ্রাম

বদর যুদ্ধঃ বদর যুদ্ধ ইসলাম ধর্মের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ঘটনা, যা ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ, ২য় হিজরীর ১৭ রমজান মাসে ঘটে। এটি প্রথম ইসলামিক যুদ্ধ, যেখানে মুসলমানরা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করে। যুদ্ধটি বদর নামক স্থানে ঘটে, যা মদিনার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।

মুসলিম বাহিনীতে মোট ৩১৩ জন সৈনিক ছিলেন। এর মধ্যে মুহাজিরদের সংখ্যা ছিল ৮২ জন এবং আনসারদের মধ্যে আওস গোত্রের ৬১ জন এবং খাজরাজ গোত্রের ১৭০ জন। মুসলিম বাহিনীর কাছে ৭০টি উট ও দুইটি ঘোড়া ছিল। এই কারণে সৈন্যরা পায়ে হেঁটে বা উটে পালাক্রমে চলাচল করতে বাধ্য হয়েছিল।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) সার্বিক নেতৃত্বের জন্য মুসআব ইবনে উমাইরকে একটি সাদা পতাকা প্রদান করেন, যা ছিল ইসলামী বাহিনীর প্রতীক। মুহাজিরদের জন্য আলী ইবনে আবি তালিব ও আনসারদের জন্য সাদ ইবনে মুয়াজকে একটি করে কালো পতাকা দেওয়া হয়, যা তাদের দলের পরিচয় ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করেছিল। যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে ডান দিকের এবং মিকদাদ ইবনে আমরকে বাম দিকের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। কাইস ইবনে আবিকে পেছনের অংশের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, যাতে পিছনের দিকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় যুদ্ধ চলতে পারে। হজরত মুহাম্মদ (সা.) পুরো বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তাঁদের নেতৃত্বের মাধ্যমে সৈন্যদের মধ্যে বিশ্বাস ও সাহস যোগান।

এদিকে মক্কায় আবু জাহলের নেতৃত্বে ১,৩০০ সৈনিকের একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয়। বাহিনীতে ছিল প্রচুর উট, ১০০ ঘোড়া, এবং ৬০০ লৌহবর্ম। এ বাহিনীর সদস্যরা অনেক অভিজাত কুরাইশ, যারা নিজেদের সম্পদের রক্ষা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। কুরাইশরা বিশ্বাস করেছিল যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহজেই বিজয়ী হবে। আবু লাহাব যুদ্ধে সরাসরি অংশ না নিয়ে ঋণের বিনিময়ে আসি ইবনে হিশাম ইবনে মুগিরাকে পাঠান। উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রথমে যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, উকবা ইবনে আবু মুয়াইত তাকে অপমানিত করে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে। আবু সুফিয়ান ক্রমাগত খবরাখবর সংগ্রহ করছিলেন। তিনি মদিনার বাহিনীর উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন এবং স্থানীয় লোকজনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেন।  আবু সুফিয়ান যখন জানতে পারেন যে কাফেলা নিরাপদে চলে গেছে, তখন তিনি মক্কার বাহিনীকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তবে আবু জাহল তাঁর জেদের কারণে যুদ্ধ না করে ফিরে যেতে রাজি হননি। কুরাইশদের মধ্যে বনু আদি গোত্রের কেউ এই যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

মক্কার বাহিনীর মধ্যে ফিরে যাওয়ার পক্ষে মতদান শুরু হলে, বেশিরভাগ সৈনিক ফিরে যাওয়ার পক্ষে ছিল। কিন্তু আবু জাহলের নেতৃত্বে তাঁরা যুদ্ধের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ছিলেন। নু জুহরা গোত্রের সদস্যরা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে, তাদের সংখ্যা কমে যায় এবং ১,০০০ সৈনিকের একটি বাহিনী প্রস্তুত হয়। মক্কার বাহিনী বদর উপত্যকায় এসে আশ্রয় নেয়, যেখানে তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।

যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশরা শক্ত প্রতিরোধ করলেও তাদের প্রধান সেনাপতি আবু জাহেলের নিহত হওয়ার পর তাদের পক্ষে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, এবং তারা দ্রুত পালিয়ে যেতে শুরু করে।

আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে, মুহাম্মাদের সামরিক কৌশল এবং মুসলমানদের সাহসিকতা ছিল এই বিজয়ের মূল কারণ। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ রিচার্ড এ. গ্যাব্রিয়েল উল্লেখ করেন যে মুহাম্মাদের কৌশল এবং সাহসিকতাই এই যুদ্ধে বিজয়ের প্রধান কারণ। অন্যদিকে, কুরআনের কিছু আয়াত এবং পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক বর্ণনাগুলি জানায় যে যুদ্ধের সময় মুসলমানদের সহায়তায় ফেরেশতাদের পাঠানো হয়েছিল।

এই যুদ্ধে মুসলমানরা ৭০ জন কুরাইশ সৈন্যকে হত্যা করে এবং ৭০ জনকে বন্দি করে, যেখানে মুসলমানদের মাত্র ১৪ জন শহীদ হন। বন্দিদের প্রতি মুহাম্মাদ উদার আচরণ প্রদর্শন করেন, যার মধ্যে মাত্র দুজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং বাকি বন্দিদের আর্থিক মুক্তিপণ অথবা পড়া-লেখা শেখানোর বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হয়। এই যুদ্ধ মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধি করে এবং ইসলামের প্রসারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি স্থাপন করে।

উহুদের যুদ্ধ

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে পরাজিত হওয়ার পর মক্কার কাফিররা প্রতিশোধের আগ্রহে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনী গঠন করে, যাতে ২০০ জন অশ্বারোহী, ৭০০ জন বর্মধারীসহ প্রায় ৩,০০০ সৈন্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং শামের বাণিজ্যপথে তাদের নিয়ন্ত্রণ কাফিরদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই তারা মুসলিমদের শক্তিকে দমন করতে চেয়েছিল।

মুহাম্মাদের (স.) চাচা আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব, যিনি তখনও মক্কায় অবস্থান করছিলেন, এই আগ্রাসনের পরিকল্পনার খবর মদিনায় পাঠান। চিঠি পাওয়ার পর মুহাম্মাদ তার সাহাবীদের নিয়ে মক্কার বাহিনীর মোকাবিলায় কৌশল নির্ধারণ করেন। যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০০০ জন।

মক্কার সৈন্যবাহিনী ৬২৫ সালের ১১ মার্চ মদিনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে এবং উহুদ পর্বতের পাদদেশে দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। মুহাম্মাদ উহুদ পর্বতের সংকীর্ণ গিরিখাতের দুই পাশে তীরন্দাজদের মোতায়েন করেন, যাতে শত্রু বাহিনী পাশ কাটিয়ে পেছন থেকে আক্রমণ করতে না পারে। তিনি তীরন্দাজদের স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেন, "নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত তোমরা তোমাদের অবস্থান ত্যাগ করবে না!"

যুদ্ধের শুরুতে মুসলমানরা শক্তিশালী আক্রমণ চালিয়ে মক্কার বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে। তবে, মুসলিম ধনুর্ধরদের একাংশ দ্রুত বিজয়ের ভুল ধারণা পোষণ করে তাদের নিয়োজিত স্থান ত্যাগ করে মক্কার বাহিনীর ফেলে যাওয়া সম্পদ সংগ্রহ করতে চলে যায়। এই অবস্থায়, কৌশলী সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ ফাঁকা অবস্থান লক্ষ্য করে মক্কার বাহিনী নিয়ে পিছন দিক থেকে মুসলিমদের উপর আক্রমণ চালান। এই আকস্মিক আক্রমণ মুসলিম বাহিনীর ভেতরে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে এবং তারা পিছু হটতে শুরু করে।

পরবর্তীতে, মক্কার বাহিনী পুনরায় ফিরে এসে মুসলিমদের আক্রমণ করে, এবং মুসলিম বাহিনী বাধ্য হয়ে উহুদ পর্বতের দিকে সরে যায়। তীরন্দাজদের সাহায্যে মুসলমানরা পর্বতের আশ্রয় নিয়ে মক্কার বাহিনীকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। যদিও মক্কার বাহিনী নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তবুও এই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যুদ্ধ শেষে, মুসলিমদের ৭০ জন সৈনিক শহীদ হন, যাদের মধ্যে মুহাম্মাদের প্রিয় চাচা হামযাও ছিলেন। মুহাম্মাদ নিজেও এই যুদ্ধে গুরুতর আহত হন।

মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান এই যুদ্ধকে বদর যুদ্ধে মুসলিমদের কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে বর্ণনা করেন। 

খন্দক যুদ্ধ

৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধ (অথবা আহজাবের যুদ্ধ) মুসলিমদের জন্য প্রতিরক্ষামূলক কৌশলের একটি স্মরণীয় উদাহরণ। মক্কার কুরাইশরা তাদের মিত্র গোত্রদের সাথে মিলিয়ে ১০,০০০ জন সৈন্য এবং ৬০০ অশ্বারোহী নিয়ে মদিনার উপর আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করে। মদিনার মুসলিমদের পক্ষে প্রায় ৩,০০০ পদাতিক সৈন্য ছিল, যাদের নেতৃত্ব দেন মুহাম্মাদ। এ সময় সালমান আল-ফারসি প্রস্তাব দেন, শত্রুর অগ্রযাত্রা থামাতে শহরের কিছু কৌশলগত স্থানে পরিখা বা খন্দক খনন করা উচিত। এই প্রতিরক্ষা কৌশল আরব অঞ্চলে ছিল বিরল, এবং তা মদিনার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাথে মিলে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই কারণেই এই যুদ্ধ “খন্দকের যুদ্ধ” নামে পরিচিতি লাভ করে।

মুসলিমরা শক্ত প্রতিরক্ষা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, এবং পরিখার কারণে মক্কার বাহিনীর অশ্বারোহী এবং উট-বহর অকার্যকর হয়ে পড়ে। তবুও, মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কুরাইজা মক্কার বাহিনীর প্ররোচনায় মুসলিমদের সাথে তাদের চুক্তিভঙ্গ করে এবং দক্ষিণ দিক থেকে মদিনার উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। বনু কুরাইজা এভাবে মদিনা চুক্তির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, যেখানে শহরের সকল গোত্রের একতাবদ্ধ হয়ে বাইরের আক্রমণ প্রতিহত করার অঙ্গীকার ছিল।

মুহাম্মাদের (স.) কূটনৈতিক কৌশল এবং কঠোর প্রতিরক্ষার ফলে মুসলিমরা মক্কার বাহিনীকে আটকে রাখতে সক্ষম হয়। দীর্ঘ এক মাস ধরে অবরোধ চলতে থাকে। তবে ঠান্ডা আবহাওয়া এবং আকস্মিক ঝড়ের কারণে মক্কার বাহিনী শেষে তাদের অবরোধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ফলে, মুসলমানরা এই যুদ্ধে বিজয়ী হিসেবে চিহ্নিত হয়। যুদ্ধের শেষে মুসলিম বাহিনী সামান্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়—মাত্র ১-৫ জন হতাহতের শিকার হলেও, মক্কার বাহিনী প্রায় ১০ জন সৈন্য হারায়।

হুদাইবিয়ার চুক্তি

হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়। ৬২৮ সালে নবী মুহাম্মাদ ও সাহাবীরা কাবা জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে যাত্রা শুরু করলে মক্কার অধিবাসীরা তাদের শহরে প্রবেশে বাধা দেয়। যুদ্ধ নিষিদ্ধ মাস চলমান থাকায় মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেনি। তারা তাই এক আপসের প্রস্তাব নিয়ে আসে, এবং দুই পক্ষের মধ্যে ১০ বছরের জন্য যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা হুদায়বিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত।

চুক্তির মূল শর্তগুলো ছিল:

  1. যুদ্ধবিরতি: ১০ বছরের জন্য উভয় পক্ষ একে অপরের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ করবে না।
  2. নিরাপত্তা: এই সময়ে কেউ কারো জান-মালের ক্ষতি করতে পারবে না।
  3. কাবা জিয়ারত: ঐ বছর মুসলমানরা কাবা জিয়ারত না করে ফিরে যাবে এবং পরের বছর তারা তিন দিনের বেশি না থেকে কাবা জিয়ারত করতে পারবে।

হুদায়বিয়ার সন্ধি মুসলিমদের জন্য এক বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এটি মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের একপ্রকার স্বীকৃতি প্রদান করে। চুক্তির মাধ্যমে মুসলিমরা মক্কার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয় এবং তাদের শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামের প্রচার করতে সুবিধা লাভ করে। চুক্তির ফলে মুসলিমদের মক্কা জয়ের পথও সুগম হয়, এবং পরে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমরা শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় করতে সক্ষম হয়।

ইসলামে দাওয়াত ও আমন্ত্রণ

৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে হুদাইবিয়ার সন্ধি সম্পন্ন হওয়ার পর, মুহাম্মাদ (স.) আল্লাহর নির্দেশে বিভিন্ন দেশের শাসকদের কাছে ইসলামে আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি প্রেরণ করেন। এসব চিঠি ইসলামের বাণী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ প্রসঙ্গে কুরআনে বেশ কিছু আয়াতও উল্লেখ আছে। চিঠি প্রাপকদের মধ্যে ছিলেন বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াস (৬১০-৬৪১), সাসানি সম্রাট দ্বিতীয় খসরু (৫৯০-৬২৮), আবিসিনিয়ার রাজা নাজাশি, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার পিতৃপতি মুকাওকিস, সিরিয়ার গাসানি শাসকগণ এবং ইয়েমেন, ওমান, ও বাহরাইনের শাসকরা। যদিও এই চিঠিগুলোর প্রামাণিকতা নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে এবং কিছু গবেষক এগুলোকে "ভুয়া" বলে দাবি করেছেন, তবে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও ইসলামী সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ইরফান শহীদ মনে করেন যে মুহাম্মাদ প্রেরিত এই চিঠিগুলোকে "ভুয়া" বলে উড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। তিনি বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসকে পাঠানো চিঠিটির ঐতিহাসিক প্রমাণ হিসেবে সাম্প্রতিক গবেষণার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন, যা চিঠিটির সত্যতা সমর্থন করে।

মুহাম্মাদ কর্তৃক বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে প্রেরিত চিঠি।

ইসলামী ইতিহাস অনুসারে, ৬২৮ সালে নবী মুহাম্মাদ বাইজেন্টাইন সম্রাট হেরাক্লিয়াসের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে তিনি সম্রাটকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানান। চিঠিটি প্রেরণ করতে দাহিয়া কালবী নামে একজন সাহাবিকে দূত হিসেবে নির্বাচন করা হয়। দাহিয়ার মূল দায়িত্ব ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বুসরা প্রদেশের গভর্নরের কাছে চিঠিটি পৌঁছানো, তবে সম্রাট হেরাক্লিয়াসের জেরুজালেমে উপস্থিতির খবর পেয়ে তাকে সরাসরি সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করতে বলা হয়।

ইতিহাসের তথ্যমতে, দাহিয়া কালবী সম্রাট হেরাক্লিয়াসের সামনে উপস্থিত হন এবং চিঠিটি তাকে সম্মানের সাথে প্রদান করেন। এই সাক্ষাৎকারে মক্কার কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানও উপস্থিত ছিলেন, যিনি গাজার ব্যবসায়িক সফরে ছিলেন। সম্রাট হেরাক্লিয়াস চিঠিটি গ্রহণ করার পর ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী ছিলেন, তবে তিনি তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না।

নবী মুহাম্মাদের (স.) এই চিঠি পাঠানো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা, কারণ এটি শুধু মক্কা বা আরবের সীমানা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এটি বিশ্বব্যাপী ইসলামের বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার একটি পদক্ষেপ ছিল। এটি প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ শুধু আরব অঞ্চলের নেতা ছিলেন না, বরং তিনি একটি বৈশ্বিক নেতৃস্থানীয় ভূমিকাও পালন করছিলেন।

মক্কা বিজয়

মক্কার কুরাইশদের একটি শাখা হুদাইবিয়ার সন্ধি  লঙ্ঘন করার পর, মুহাম্মাদ  ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে একটি বিশাল মুসলিম বাহিনী গঠন করে মক্কা অবরোধ করেন। মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান তখন মুহাম্মাদের সাথে দেখা করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেন। মুহাম্মাদ আবু সুফিয়ানসহ অনেক মক্কাবাসীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘোষণা দেন, যারা তার বাড়িতে আশ্রয় নেবে। একই সময়ে, মুহাম্মাদের চাচা আব্বাস মক্কাবাসীদের একই বার্তা দেন, এবং তাদের মসজিদুল হারামে বা নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি দেন।

১১ জানুয়ারি ৬৩০ সালে, মুসলিম বাহিনী খুব কম আক্রমণের মাধ্যমে এবং প্রায় রক্তপাত ছাড়াই মক্কা বিজয় করে। মক্কায় প্রবেশ করার পর, মুহাম্মাদ (স.) আবু সুফিয়ানকে জানিয়ে দেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কাউকে আঘাত করা হবে না এবং তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। এরপর, তিনি কাবার কাছে এগিয়ে যান, যেখানে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করা ছিল। সূরা ইসরা-এর ৮১তম আয়াত পাঠ করে, মুহাম্মাদ একের পর এক মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলেন। বিলাল হাবেশী আযান দেন এবং মুহাম্মাদ তার সঙ্গী মুসলিমদের সাথে কাবা তাওয়াফ করেন।

বিজয়ের পর, কিছু মক্কাবাসী মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করে। মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম আরব উপদ্বীপে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে।

আরব বিজয়

মক্কা বিজয়ের পর, মুহাম্মাদ হাওয়াজিন গোত্রের মিত্রসংঘের সামরিক হুমকির সম্মুখীন হন। হাওয়াজিন ছিল মক্কার পুরোনো শত্রু, এবং মক্কার প্রতিপত্তি হ্রাসের পর তারা মক্কা বিরোধী নীতি গ্রহণ করে। মুহাম্মাদ হুনাইনের যুদ্ধে হাওয়াজিন এবং সাকিফ গোত্রকে পরাজিত করেন।

একই বছর, মুহাম্মাদ উত্তর আরবে একটি অভিযান পরিচালনা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পূর্ববর্তী পরাজয় এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা প্রদর্শনের জন্য। তিনি ৩০,০০০ সৈন্য সমাবেশ করেন, তবে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই দ্বিতীয় দিনে মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে অর্ধেক সৈন্যকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। যদিও মুহাম্মাদ তাবুক অঞ্চলে শত্রু বাহিনীর সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াননি, তবুও তিনি এই অঞ্চলের কিছু স্থানীয় নেতাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করেন।

পূর্ব আরবে অবশিষ্ট সকল মূর্তি ধ্বংস করার জন্য মুহাম্মাদ নির্দেশ দেন। পশ্চিম আরবে, তায়েফ ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকারী শেষ শহর, যেখানে মুহাম্মাদ তাদের আত্মসমর্পণ গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান যতক্ষণ না তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং পুরুষরা দেবী লাত-এর মূর্তি ধ্বংস করতে সম্মত হয়।

তাবুক যুদ্ধের এক বছর পর, বনু সাকিফ মুহাম্মাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে এবং ইসলাম গ্রহণ করতে দূত পাঠায়। অনেক বেদুঈন তাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এবং যুদ্ধের লভ্যাংশ ভাগ করে নিতে মুহাম্মাদের কাছে আনুগত্য স্বীকার করে। তবে, বেদুঈনরা ইসলামী ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিল না এবং তারা তাদের স্বাধীনতা, অর্থাৎ তাদের নিজস্ব নীতিমালা এবং পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেয়েছিল। মুহাম্মাদ (স.) তখন তাদের জন্য একটি সামরিক ও রাজনৈতিক চুক্তির প্রস্তাব করেন, যা ছিল "মদিনার শাসন গ্রহণ করা, মুসলমান এবং তাদের মিত্রদের আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকা, এবং মুসলমানদের ধর্মীয় কর যাকাত প্রদান করা"।

বিদায়ী ভাষণ ও মৃত্যু

কিছু ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, মুহাম্মাদকে (স.) বিষ প্রয়োগ করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। ৬২৯ সালে খায়বারের বিজয়ের পর, খায়বারের এক ইহুদি নারী, যাঁর নাম ছিলো জয়নব, তার নিহত আত্মীয়দের প্রতিশোধ নিতে মুহাম্মাদকে বিষাক্ত খাসির মাংস পরিবেশন করেছিলেন। মুহাম্মাদ খাবার গ্রহণ করেই বুঝতে পারেন যে তা বিষাক্ত এবং তিনি তার সাহাবীদের সতর্ক করেন। তবে, সাহাবী বিশর ইবনে বেরা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জয়নব পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে ক্ষমা পান, তবে মুহাম্মাদ দীর্ঘদিন ধরে এই বিষক্রিয়ার কারণে শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলেন।

৬৩২ সালের মার্চ মাসে (৯ই জিলহজ্জ), মুহাম্মাদ তার বিদায়ী হজ্জ পালন করেন। হজ্জের সময়, তিনি আরাফাত পর্বতের রহমত পাহাড়ে ১০০,০০০ এরও বেশি মুসলমানের উপস্থিতিতে 'বিদায়ী ভাষণ' প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি মুসলিমদের প্রতি তার শেষ পরামর্শ দেন, বিশেষত দাসদের প্রতি সদয় আচরণ এবং নামাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। হজ্জ থেকে মদিনায় ফিরে আসার পর, মুহাম্মাদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জীবনের শেষ মুহূর্তে তার স্ত্রী আয়িশা এবং তার কন্যারা তার পাশে ছিলেন। বর্ণনা অনুসারে, মুহাম্মাদ তার শেষ বাণীতে মুসলিমদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, "তোমাদের হাতে থাকা দাসদের প্রতি সদয় আচরণ করো, নামাজের প্রতি মনোযোগ দাও এবং নিয়মিত আদায় করো।" তিনি আয়িশার কোলে মাথা রেখে শাহাদাহ পাঠ করেন। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা শেষ বাক্যটি ছিল "আল্লাহুম্মা আর-রাফিকুল 'আলা..." (যার অর্থ "সর্বোচ্চ বন্ধুর জন্য!")। ৮ই জুন ৬৩২ সালে মদিনায় মুহাম্মাদ (স.) শাহাদৎবরণ করেন। তাকে মসজিদে নববীর পাশে, হযরত আয়িশার ঘরের পাশে সমাহিত করা হয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post