ইয়াক- Yak
ইয়াক- Yak (Bos grunniens), যা টার্টারি বলদ, গ্রন্টিং বলদ বা লোমশ গবাদি পশু নামেও পরিচিত। এটি নেপাল, সিকিম (ভারত), তিব্বত মালভূমি (চীন), তাজিকিস্তান এবং মঙ্গোলিয়া এবং সাইবেরিয়া, গিলগিট-বালতিস্তানের (কাশ্মীর, পাকিস্তান) হিমালয় অঞ্চল জুড়ে পাওয়া লম্বা কেশিক গৃহপালিত গবাদি পশুর একটি প্রজাতি। এটি বন্য ইয়াক (Bos mutus) থেকে এসেছে।
ইয়াক গরু জাতীয় প্রাণী হলেও এরা অপেক্ষাকৃত বড় এবং প্রচণ্ড ঠান্ডা পরিবেশে টিকে থাকার জন্য উপযোগী। ইয়াকের শরীরে ঘন ও লম্বা লোম থাকে, যা শীত থেকে রক্ষা করে।
ইয়াকের দুগ্ধ থেকে দই, মাখন এবং বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি করা হয়। স্থানীয় জনগণের জীবিকা নির্বাহ এবং পরিবহন কাজে ইয়াক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ব্যুৎপত্তি
ইংরেজি শব্দ Yak ইয়াক তিব্বতি Wylie: g.yag থেকে এসেছে। তিব্বতি এবং বাল্টিতে এটি
শুধুমাত্র পুরুষ প্রজাতি কে বোঝায়, স্ত্রী প্রজাতিকে , Wylie: dri বলা হয়। ইংরেজি
সহ অন্যান্য বেশিরভাগ ভাষায় ইয়াক শব্দটি উভয়
লিঙ্গের জন্য ব্যবহৃত হয়।
শ্রেণীবিন্যাস
বস গোত্রের অন্তর্গত, ইয়াক গবাদি পশুর সাথে
সম্পর্কিত (বস প্রিমিজিনিয়াস)। ইয়াকের বিবর্তনীয় ইতিহাস নির্ণয় করতে মাইটোকন্ড্রিয়াল
ডিএনএ বিশ্লেষণ এখনও অমীমাংসিত।
ইয়াক এক থেকে পাঁচ মিলিয়ন বছর আগে যেকোনো
সময়ে গবাদি পশু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা। তবে কেউ কেউ মনে করেন এটি
এর মনোনীত গণের অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় বাইসনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত হতে
পারে। ইয়াকের আপাত ঘনিষ্ঠ জীবাশ্ম, যেমন বস বাইকালেন্সিস, পূর্ব রাশিয়ায় পাওয়া
গেছে।
১৭৬৬ সালে লিনিয়াস দ্বারা প্রজাতিটিকে মূলত
Bos grunniens ("grunting ox") হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল, কিন্তু এই নামটি
এখন সাধারণত শুধুমাত্র এর গৃহপালিত রূপকে বোঝানো হয়। বন্য প্রজাতির জন্য Bos
mutus ("নিঃশব্দ বলদ") অধিক প্রযোজ্য। যদিও কিছু লেখক এখনও বন্য ইয়াককে
বোস গ্রুনিয়েন্স মুটাস একটি উপ-প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা করেন, আইসিজেডএন ২০০৩ সালে
বন্য ইয়াকদের জন্য বোস মুটাস নাম ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে একটি সরকারী রায় দেয়।
ইয়াকের শারীরিক বৈশিষ্ট্য
ইয়াকের শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের শীতপ্রধান এবং উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য বিশেষভাবে মানানসই। ইয়াকের গায়ে লম্বা ও ঘন লোম থাকে, যা তাদের প্রচণ্ড ঠান্ডা পরিবেশে গরম রাখতে সহায়তা করে। শরীরের বাইরের লোমগুলো বেশ শক্ত এবং অভ্যন্তরীণ লোমগুলো নরম ও তুলনামূলকভাবে উষ্ণ হয়, যা শরীরের তাপ ধরে রাখে।
ইয়াকের শরীর পেশীবহুল ও শক্তিশালী, যা তাদের পার্বত্য অঞ্চলের কঠোর পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এদের শক্তিশালী পায়ে খাড়া পাথর বেয়ে উঠা এবং ওজন বহন করা সহজ হয়। ইয়াকদের ফুসফুস এবং হৃদপিণ্ড বড় হয়, যা কম অক্সিজেনযুক্ত উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে নিঃশ্বাস নিতে সুবিধা দেয়। এটি উচ্চতায় অক্সিজেনের স্বল্পতা মোকাবিলা করতে সাহায্য করে।ইয়াকের শিং বড় এবং কিছুটা বাঁকানো থাকে, যা আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে পুরুষ ইয়াকের শিং বড় এবং শক্তিশালী হয়।
ইয়াকের চামড়া মোটা ও সুরক্ষামূলক, যা ঠান্ডা হাওয়া এবং তুষারপাত থেকে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। তাদের ত্বক শীতের মৌসুমে আরও ঘন হয়ে যায়। ইয়াকের খুর শক্তিশালী এবং পার্বত্য অঞ্চল বা পাথুরে ভূমিতে চলাচলের উপযোগী। তাদের খুর এমনভাবে গঠিত যে তা পাথরে দৃঢ়ভাবে স্থির হয়ে চলতে সাহায্য করে। এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যগুলো ইয়াকদের ঠান্ডা আবহাওয়া, উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল এবং কঠিন ভূখণ্ডে টিকে থাকার জন্য বিশেষভাবে সক্ষম করে তুলেছে।
ইয়াকের প্রজনন এবং জীবনের ইতিহাস
ইয়াকের প্রজনন এবং জীবনের ইতিহাস বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। এদের প্রজনন চক্র এবং জীবনধারা কঠোর পার্বত্য ও ঠান্ডা আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পারে। ইয়াক মূলত তিব্বত, নেপাল, মঙ্গোলিয়া, এবং চীনের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে জীবনধারা ও প্রজনন প্রক্রিয়া ভিন্নভাবে গড়ে উঠেছে। নিচে ইয়াকের প্রজনন এবং জীবনের ইতিহাস তুলে ধরা হলো:
1. প্রজনন ঋতু
- ইয়াকের প্রজনন ঋতু সাধারণত গ্রীষ্মকালে, বিশেষত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে হয়। এই সময়ে আবহাওয়া অপেক্ষাকৃত উষ্ণ থাকে, যা জন্ম নেয়া বাচ্চাদের ঠান্ডা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
- প্রজনন ঋতুতে পুরুষ ইয়াকরা মাদী ইয়াকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বিভিন্ন আচার-আচরণ প্রদর্শন করে, যেমন গর্জন করা, শিং দিয়ে লড়াই করা এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পুরুষ ইয়াকদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া।
2. গর্ভধারণ এবং গর্ভকাল
- মাদী ইয়াকের গর্ভকাল সাধারণত ৮-৯ মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এদের গর্ভকালীন সময় এমনভাবে সাজানো যে শীতের শেষে বা বসন্তকালে বাচ্চা জন্ম নিতে পারে, যখন আবহাওয়া কিছুটা উষ্ণ থাকে।
- প্রাকৃতিকভাবে, মাদী ইয়াক একবারে একটি বাচ্চা জন্ম দেয়। যমজ জন্ম দেয়া বিরল ঘটনা।
3. জন্ম এবং বাচ্চাদের বিকাশ
- সাধারণত বাচ্চা ইয়াক জন্মের পরপরই চলাফেরা করতে সক্ষম হয়, যা তাদেরকে শিকারী প্রাণীর হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
- বাচ্চারা তাদের মায়ের দুধ পান করে এবং সাধারণত এক বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে থাকে।
- ইয়াকের দুধ অত্যন্ত পুষ্টিকর, যা বাচ্চাদের দ্রুত বৃদ্ধি এবং শীত থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
4. জীবনচক্র এবং পরিণত বয়স
- ইয়াক সাধারণত ৬-৮ বছর বয়সে পূর্ণবয়স্ক হয় এবং প্রজননের জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে। মাদী ইয়াক সাধারণত প্রতি দুই বছরে একবার প্রজনন করে।
- প্রাকৃতিক পরিবেশে ইয়াকের গড় আয়ু ২০ বছর পর্যন্ত হতে পারে, যদিও গৃহপালিত ইয়াক কিছু ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে।
5. পরিবেশ এবং জীবনধারা
- ইয়াকের জীবনধারা উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল এবং ঠান্ডা পরিবেশের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এরা সাধারণত দলবদ্ধভাবে বাস করে এবং গ্রীষ্মে পাহাড়ের উঁচু অংশে এবং শীতকালে অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলে চলে আসে।
- এদের খাদ্যতালিকায় মূলত ঘাস, গুল্ম, এবং পাহাড়ি উদ্ভিদ থাকে। কঠোর পরিবেশে এরা কম পানিতেও টিকে থাকতে সক্ষম হয় এবং তুষার ও বরফ গলিয়ে পানি সংগ্রহ করে।
6. প্রজনন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ
- ইয়াকের প্রজনন সাধারণত শীতপ্রধান অঞ্চলে ঘটে, যা আবহাওয়া সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। বন্য পরিবেশে শিকারী প্রাণী এবং কঠোর আবহাওয়ার কারণে বাচ্চাদের বেঁচে থাকার হার কিছুটা কম।
- এছাড়াও আবহাওয়ার পরিবর্তন, খাদ্য সংকট এবং বাসস্থান সংকটের কারণে কিছু ক্ষেত্রে ইয়াকের প্রজনন ক্ষমতা ও সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।