সিরাজ সিকদার - Siraj Sikder
সিরাজুল হক সিকদার (বাংলা: সিরাজুল হক সিকদার;
২৭ অক্টোবর ১৯৪৪ - ২ জানুয়ারী ১৯৭৫), সিরাজ সিকদার নামে বেশি পরিচিত, ছিলেন একজন বাংলাদেশী
বিপ্লবী রাজনীতিবিদ।
সিকদার ১৯৪৪ সালের ২৭ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের
শরীয়তপুর জেলার লাকার্তা উপজেলা ভেদরগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আব্দুর
রাজ্জাক সিকদার, এবং তিনি ছায়াগাঁওয়ের একজন বাঙালি মুসলিম জমিদার পরিবারের সদস্য
ছিলেন। সিকদার ১৯৫৯ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর ১৯৬১ সালে
বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে আইএসসিতে ভর্তি হন। তিনি ১৯৬৭ সালে ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি
অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বর্তমানে বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি
অর্জন করেন।
ছাত্র থাকাকালীন তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র
ইউনিয়নের সদস্য হন। ১৯৬৭ সালে, তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি
নির্বাচিত হন এবং সেই বছরই তিনি প্রকৌশলী হিসাবে সরকারের C&B বিভাগে যোগদান করেন।
তিন মাস পর তিনি চাকরি ছেড়ে টেকনাফে ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি কোম্পানি
শুরু করেন।
রাজনৈতিক কার্যকলাপ
৮ জানুয়ারী ১৯৬৮ সালে, সমমনা কর্মীদের নিয়ে,
সিকদার বিদ্যমান "কমিউনিস্ট" সংগঠনগুলির সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের
নেতৃত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন (ইস্ট বেঙ্গল শ্রমিক আন্দোলন
EBWM) নামে একটি গোপন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। এই উদ্যোগটি একটি থিসিস সামনে
নিয়ে আসে যে, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একটি উপনিবেশ এবং সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব একদিকে
পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া এবং সামন্তবাদীদের মধ্যে এবং অন্যদিকে পূর্ব বাংলার
জনগণের মধ্যে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সমাজ-সাম্রাজ্যবাদ এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের
নিপীড়ন থেকে মুক্ত পূর্ব বাংলার একটি "স্বাধীন, গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ, জোট
নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল" গণপ্রজাতন্ত্র গঠনে একমাত্র স্বাধীনতা সংগ্রামই সমাজকে সমাজতন্ত্রের
দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে,
সিকদার ঢাকায় মাও সে তুং গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরে পাকিস্তান সরকার
তা বন্ধ করে দেয়। সিকদার ঢাকার টেকনিক্যাল টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক হন।
১৯৭০ সালে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন বিপ্লবী পরিষদ পাকিস্তানি প্রশাসন ও শ্রেণি শত্রুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় গেরিলা অভিযান চালায়। এই বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ জেলায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা উত্তোলন করে তাদের আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে। এরপর, ১৯৭১ সালের ২ মার্চ, এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লেখে যা লিফলেট আকারে সারা দেশে প্রচারিত হয়। এই চিঠির চার নম্বর দফায় প্রস্তাব করা হয়েছিল পূর্ব বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি জাতীয় মুক্তি পরিষদ বা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের।
যুদ্ধের সময়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ঝালকাটি
জেলার ভিমরুলীর পেয়ারাবাগান নামে একটি মুক্ত ঘাঁটি এলাকায়, ১৯৭১ সালের ৩ জুন, সিকদার
মার্কসবাদ এবং মাওসেতুং চিন্তাধারার ("মাওবাদ" নয়, ১৯৬০-এর দশকে মাও-লাইনের
অনুসারীরা তাদের মতাদর্শকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সে-তুং চিন্তাধারা হিসাবে চিহ্নিত
করতেন) আদর্শে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি (পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি) নামে একটি
নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেন। যুদ্ধের শুরুতে, তিনি বরিশালে গিয়েছিলেন এবং তিনি এটিকে একটি
মিক্তাঞ্চল হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন এবং এটিকে নিজের ঘাঁটি বানিয়ে অন্যান্য জায়গায়
তাঁর বিপ্লবের সূচনা করার চেষ্টা করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি শেখ মুজিব
সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এপ্রিল ১৯৭৩ সালে, তিনি পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি
ফ্রন্ট ("পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট") গঠন করেন এবং বাংলাদেশ সরকারের
বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার নেতৃত্বে সর্বহারা দল মহাজন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে হামলা
চালায়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি গঠন
সিরাজ সিকদার নেতৃত্বে ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালের সময়কালে পূর্ব বাংলায় বামপন্থী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল। পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল বরিশালের পেয়ারা বাগানে পূর্ব বাংলার সশস্ত্র দেশপ্রেমিক বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি বাহিনী এবং শোষণমূলক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া।
পরে, ৩ জুন ১৯৭১-এ, এই দলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি। সর্বহারা পার্টির লক্ষ্য ছিল মাওবাদী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজের নিপীড়িত শ্রেণির স্বাধীনতা অর্জন এবং শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। পার্টির আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পাকিস্তানকে উপনিবেশবাদী, ভারতকে আধিপত্যবাদী এবং আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
বরিশালের পেয়ারা বাগানে ঘাঁটি স্থাপন
১৯৭১ সালের জুন মাসে বরিশালের পেয়ারা বাগানে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির যাত্রা শুরু হয়। ঐতিহাসিক এই সম্মেলনে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। এখানে নারী-পুরুষের সমাবেশ ছিল এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রতীক। দলটি বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চল—যেমন বিক্রমপুর, মানিকগঞ্জ, পাবনা এবং ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সফল গেরিলা আক্রমণ চালায়।
সর্বহারা পার্টি ও আওয়ামী লীগের বিভাজন
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সর্বহারা পার্টি প্রথমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কিছুটা ঐক্যবদ্ধ থাকে এবং অনেক নেতা-কর্মীকে আশ্রয় দেয়। তবে আগস্টের পর, রাজনৈতিক বিভাজন বাড়তে থাকে। মুজিববাহিনীর সঙ্গে সংলাপের উদ্দেশ্যে পাঠানো সর্বহারা পার্টির কয়েকজন সদস্য নিহত হলে, এই ঐক্য ভেঙে যায়। এর পর থেকেই আওয়ামী লীগ এবং সর্বহারা পার্টির মধ্যে তীব্র বিরোধ শুরু হয়।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সিরাজ সিকদারের ভাবনা
স্বাধীনতার পরও সিরাজ সিকদার ভারতকে বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টার জন্য দোষারোপ করেন। তিনি আওয়ামী লীগকে "জাতীয় বিশ্বাসঘাতক" আখ্যা দিয়ে "পূর্ব বাংলার অসমাপ্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব" চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। ১৬ ডিসেম্বরকে তিনি "কালো দিবস" হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং ১৯৭৩ সালে মওলানা ভাসানীর সমর্থনে দিনটি হরতাল পালন করা হয়।
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এবং তার বিপ্লবী কার্যক্রম স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের একটি শক্তিশালী ধারা প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। সিরাজ সিকদার তার সাহসী নেতৃত্ব ও আদর্শের জন্য ছাত্র-তরুণদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং দেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হন।
সিরাজ সিকদারের মৃত্যু
সিরাজ সিকদারের মৃত্যু বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিতর্কিত ও রহস্যময় অধ্যায় হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হলে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে সিরাজ সিকদার চট্টগ্রামের কাছাকাছি একটি স্থানে (সম্ভবত টেকনাফ বা হালিশহর) গ্রেফতার হন। তবে তার গ্রেফতার ও মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে, যার কারণে প্রকৃত ঘটনা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়ে গেছে।
সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস তার গ্রন্থ বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ-এ উল্লেখ করেন যে, সিরাজ সিকদারকে চট্টগ্রাম থেকে আটক করার পর ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং পরবর্তীতে সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নেয়ার পথে তাকে হত্যা করা হয়। আবার কিছু সূত্র অনুযায়ী, তাকে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকা থেকে আটক করা হয় এবং ঢাকায় আনার পর রমনা রেসকোর্স পুলিশ কন্ট্রোল রুমে রাখা হয়, যেখানে নির্জন স্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়।
পুলিশের বিবৃতিতে দাবি করা হয়, সিকদারকে একটি গোপন আস্তানায় নেয়ার সময় পালাতে চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি চালায় এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তবে এই সরকারি বিবৃতি অনেকেই অবিশ্বাস করেন এবং এটিকে একটি পূর্ব পরিকল্পিত হত্যা বলে মনে করেন। তার মৃত্যুর জন্য তার বোন শামীম শিকদার শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে।
সিরাজ সিকদারের মৃত্যু নিয়ে পরে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ, গবেষক মুনীর মোরশেদ, এবং বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব এস এ করিমসহ আরও অনেকে লেখালেখি করেছেন। তাদের লেখনীতে উঠে আসে যে, এই হত্যাকাণ্ড ছিল এক বিতর্কিত অধ্যায় যা সরকারের কিছু গোপন উদ্দেশ্য প্রকাশ করে। ১৯৯২ সালে তার মৃত্যুর ১৭ বছর পর সিরাজ সিকদারের পরিবার এবং সহকর্মীরা একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু সেই মামলার কোনো নিষ্পত্তি হয়নি এবং আজও এই মৃত্যুর প্রকৃত ঘটনা অমীমাংসিত থেকে গেছে।
সিরাজ সিকদারের মৃত্যু শুধু একজন বিপ্লবী নেতার জীবনাবসান নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে আছে যা আজও অনেকের কাছে জবাবহীন।