ভারতীয় হোম রুল আন্দোলন: স্বাধীনতার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ

 

ভূমিকা

ভারতীয় হোম রুল আন্দোলন ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল, যা আইরিশ হোম রুল আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। ১৯১৬ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে প্রায় দুই বছর স্থায়ী এই আন্দোলনটি অ্যানি বেসান্ট এবং বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল। এই সময়ে শিক্ষিত ও ইংরেজিভাষী উচ্চ শ্রেণীর ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার দাবিকে জনপ্রিয় করে তোলা হয়।

অল ইন্ডিয়া হোম রুল লীগের পরিবর্তন

১৯২০ সালে অল ইন্ডিয়া হোম রুল লীগ "স্বরাজ্য সভা" নামে পরিবর্তিত হয়। আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত পতাকায় পাঁচটি লাল ও চারটি সবুজ ফিতা ছিল, যার উপরিভাগে বামদিকে ইউনিয়ন পতাকা ছিল। পতাকার কেন্দ্রে ছিল একটি সাদা অর্ধচন্দ্র এবং একটি সাত-পয়েন্টেড তারা। এছাড়াও, সপ্তর্ষি নক্ষত্রমন্ডলের সাতটি সাদা তারাও পতাকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল।

আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

এই আন্দোলন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় শুরু হয়। ১৯০৯ সালের ভারত সরকার আইন জাতীয়তাবাদী নেতাদের দাবি পূরণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় দেশজুড়ে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। তিলকের বন্দিত্ব এবং কংগ্রেসের বিভাজন এই আন্দোলনের গতি কমিয়ে দিলেও, ১৯১৫ সালে পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে থাকে। অ্যানি বেসান্টের সক্রিয় ভূমিকা এবং তিলকের মুক্তি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে।

গদর বিদ্রোহ এবং দমনমূলক আইন

গদর বিদ্রোহ এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কঠোর দমন নীতি, যেমন ১৯১৫ সালের ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট, আন্দোলনের ভিত্তিকে আরও মজবুত করে তোলে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্যদের বিভিন্ন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পাঠানো হয়েছিল, যা বিশেষত মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অনেক ভারতীয় বিপ্লবী যুদ্ধের বিরোধিতা করেন, যদিও মধ্যপন্থী নেতারা ব্রিটিশ সরকারকে সমর্থন করলেও স্ব-শাসনের দাবি থেকে বিরত থাকেননি। অ্যানি বেসান্ট তাঁর "ইংল্যান্ডের প্রয়োজন ভারতের সুযোগ" উক্তির মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

হোম রুল লীগের প্রতিষ্ঠা

১৯১৬ সালে বাল গঙ্গাধর তিলক বেলগাঁও প্রাদেশিক কংগ্রেসে প্রথম ভারতীয় হোম রুল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে, অ্যানি বেসান্ট মাদ্রাজে দ্বিতীয় হোম রুল লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তিলকের লীগ মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, এবং কেন্দ্রিয় প্রদেশে সক্রিয় ছিল, আর বেসান্টের লীগ ভারতের অন্যান্য অংশে কাজ করত।

লখনউ চুক্তি এবং কংগ্রেস-মুসলিম লীগের সংহতি

এই আন্দোলন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগকে আরও সংহত করে, বিশেষ করে ১৯১৬ সালের লখনউ চুক্তির পর থেকে। বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা যেমন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, এবং স্যার এস সুব্রামনিয়া আইয়ার এই আন্দোলনে অংশ নেন।

আন্দোলনের শক্তিশালী রূপ

আন্দোলন তীব্রতর হওয়ায় ১৯১৭ সালে অ্যানি বেসান্ট গ্রেপ্তার হন, যা দেশব্যাপী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে। এতে ভারতের গ্রামাঞ্চলেও আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার করে এবং বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

মন্টেগু ঘোষণা

আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৭ সালের ২০ আগস্ট মন্টেগু ঘোষণার মাধ্যমে ভারতের জন্য দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। এর ফলে কিছু নেতারা আন্দোলন থেকে সরে আসেন এবং ধীরে ধীরে হোম রুল লীগের কার্যক্রম স্থগিত হয়।

গান্ধীর উত্থান এবং সত্যাগ্রহ

হোম রুল আন্দোলনের পর মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। তিনি সত্যাগ্রহের মাধ্যমে অহিংস প্রতিরোধ কৌশল চালু করেন এবং চম্পারণ ও খেদা আন্দোলনে কৃষকদের পক্ষে লড়াই করে জাতীয় নেতায় পরিণত হন।

সমাপ্তি

১৯২০ সালে হোম রুল লীগ কংগ্রেসের সাথে একীভূত হয় এবং মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই ঐক্য ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে, যা পরবর্তীতে একটি গণআন্দোলনে রূপান্তরিত হয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post