জিয়াউর রহমান (১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ – ৩০ মে ১৯৮১) ছিলেন বাংলাদেশের অষ্টম রাষ্ট্রপতি, প্রাক্তন সেনাপ্রধান এবং একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী বাঙালি জনগণের উপর আক্রমণ চালানোর পর তিনি তার পাকিস্তানি অধিনায়ককে বন্দি করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ, তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি বিবৃতি পাঠিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সমর্থন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে "বীর উত্তম" উপাধিতে ভূষিত করে।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান নেতা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার সময় জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু বিতর্কিত অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের মধ্যে ছিল সংবিধান লঙ্ঘন, শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশত্যাগে সহায়তা এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদে পদায়ন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) তার "বীর উত্তম" খেতাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে, পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ঘোষণা করেন যে, জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিল করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর, ১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল তিনি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সরিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ শাসন করার পর, ১৯৮১ সালের ৩০শে মে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে চট্টগ্রামে নির্মমভাবে নিহত হন।
২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা পরিচালিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জরিপে, ২০ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে জিয়াউর রহমানের নাম ১৯ নম্বরে স্থান পায়, যা তার রাজনৈতিক এবং মুক্তিযুদ্ধের অবদানকে স্মরণীয় করে রাখে।
জিয়াউর রহমানের জীবনের প্রথম দিক এবং পরিবার
জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি, ব্রিটিশ বেঙ্গলের বগুড়া জেলার নশিপুর ইউনিয়নের বাগবাড়ী গ্রামের মণ্ডল বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মনসুর রহমান ছিলেন কলকাতা শহরের একটি সরকারি দপ্তরে রসায়নবিদ হিসেবে কর্মরত, এবং তার মা জাহানারা খাতুন, যিনি রানী নামেও পরিচিত। তিনি ছিলেন পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয়।
জিয়াউর রহমানের পূর্বপৈত্রিক নিবাস ছিল বগুড়ার মহিষাবান গ্রামে, তবে তার দাদার বিয়ের পর পুরো পরিবার বাগবাড়ী গ্রামে বসতি স্থাপন করে। তার পরিবারের মধ্যে বিখ্যাত নেতা মুমিন উদ্দিন মণ্ডল এবং তার পুত্র কাঁকর মণ্ডল সাহেবের সরাসরি বংশধর হিসেবে জিয়াউর রহমান পরিচিত।
তার দাদা, মৌলবী কামালুদ্দীন মণ্ডল (জন্ম ১৮৫৪), ছিলেন কাঁকর মণ্ডল সাহেবের একমাত্র পুত্র এবং বাগবাড়ী মাইনর স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারে বেড়ে ওঠা জিয়াউর রহমানের জীবন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
জিয়াউর রহমানের শৈশব ও শিক্ষাজীবন
জিয়াউর রহমানের শৈশবের কিছু সময় বগুড়ার গ্রামে এবং কিছু সময় কলকাতা নগরীতে অতিবাহিত হয়। ভারতবর্ষের বিভाजन পর, তার পিতা পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি শহরে চলে যান। এর ফলে জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করে করাচি একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর ১৯৫৩ সালে তিনি করাচির ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন।
শিক্ষাজীবনে জিয়াউর রহমান উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন, এবং যদিও তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারতেন, তিনি সাবলীলভাবে বাংলা লিখতে ও পড়তে পারতেন না। ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ক্যাডেট হিসেবে কাকুল মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন, যেখানে তার সেনাবাহিনীতে প্রবেশের সূচনা হয়।
সামরিক জীবন ও বীরত্বপূর্ণ কর্ম
১৯৫৩ সালে জিয়াউর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানের কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদবীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। সামরিক বাহিনীতে তিনি একজন দক্ষ ছত্রীসেনা ও কমান্ডো হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং স্পেশাল ইন্টেলিজেন্স কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন।
করাচিতে দুই বছর কর্মরত থাকার পর ১৯৫৭ সালে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে স্থানান্তরিত হন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের দিনাজপুর শহরের খালেদা খানমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি খেমকারান সেক্টরে এক কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে অসীম সাহসিকতা প্রদর্শন করেন। এই যুদ্ধে তার কোম্পানি সর্বাধিক বীরত্বপূর্ণ পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় এবং পাকিস্তান সরকার তাকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাবে ভূষিত করে। তার ইউনিটও এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত পদক লাভ করে।
১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটাস্থিত কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে স্টাফ কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৬৯ সালে মেজর পদে তিনি দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ডের দায়িত্ব লাভ করেন। এছাড়াও, উচ্চতর প্রশিক্ষণ জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানিতে যান এবং ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে কিছু সময় কাজ করেন।
১৯৭০ সালে দেশে ফিরে আসার পর তিনি চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যেখানে তিনি তার সামরিক ক্যারিয়ারে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালায়। এ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়, তবে তার পূর্বেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই সঙ্কটময় মুহূর্তে, ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকায় পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের পর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে এবং বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করে প্রশংসিত হন।
শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পাঠানো হয়। এই ঘোষণাটি শুনে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান এবং অধ্যাপক আবুল কাশেম সন্দ্বীপ স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ করেন। তাদের ঘোষণাই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করার পর, বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তারা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করতে থাকেন। বেলাল মোহাম্মদ, বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা, মেজর রফিকুল ইসলামকে নিরাপত্তার জন্য সৈনিক পাঠানোর অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে পরবর্তীতে, বেলাল মোহাম্মদ পটিয়া সেনাছাউনিতে যান এবং মেজর জিয়া থেকে আশ্বাস পেয়ে বেতার কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন।
২৭শে মার্চ প্রথমবারের মতো এবং পরে ২৮ ও ২৯ তারিখেও তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও ইতিহাসে এক অমুল্য অবদান হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকে।
জিয়ার ঘোষণাপাঠ এবং বিতর্ক
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা ও তার ভূমিকা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চের ঘোষণায় তিনি নিজেকে অস্থায়ী সরকারপ্রধান (Provisional Head of Bangladesh) বলে দাবি করেছিলেন, যা মার্কিন একটি গোপন নথিতে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণার পর লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে রহস্যজনকভাবে, ২৮শে মার্চেও তিনি নিজেকে “Provisional Head of Bangladesh” এবং “Liberation Army Chief” হিসেবে ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের নাম থেকে 'বিপ্লবী' শব্দটি বাদ দেন, যা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশার সৃষ্টি করে। চট্টগ্রামের জনতার মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং অনেকেই বঙ্গবন্ধুর নামের অনুপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এর পর, ২৯শে মার্চ তিনি তার পূর্বের ঘোষণাগুলোর ভুল সংশোধন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে, মেজর জিয়া ও তার বাহিনী সামনের সারি থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে তারা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং কৌশলগতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেন। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের গঠন হলে, জিয়া ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তার নেতৃত্বে ১ম, ৩য় ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীর প্রথম নিয়মিত সশস্ত্র ব্রিগেড, জেড ফোর্স গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিনি ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন, এরপর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১১ নম্বর সেক্টরের এবং জেড-ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।
বীর উত্তম উপাধি
মুক্তিযুদ্ধে তার অসীম সাহসিকতা এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তার অবদানের এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন।
স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে জিয়ার পদোন্নতি এবং বিতর্ক
স্বাধীনতার পর, জিয়াউর রহমানকে কুমিল্লায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৪৪তম ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করা হয়, যেখানে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অধীনে সেনারা যুদ্ধ করেছিল। ১৯৭২ সালের জুনে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্নেল পদে ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ (উপ সেনাপ্রধান) হিসেবে নিযুক্ত হন। এর পর, ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন এবং একই বছরের অক্টোবরে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন।
১৯৭৮ সালে, রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়, জিয়া হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন এবং নিজেও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদবি গ্রহণ করেন। তবে, তার বিরুদ্ধে একটি বিতর্ক উঠেছিল, যেখানে বলা হয় যে তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের এবং পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অমুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছেন এবং অপপ্রচার চালিয়েছিলেন। এই অভিযোগটি সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী তাঁর কারাগারের ডায়রী বইতে উল্লেখ করেছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ড এবং জিয়াউর রহমানের ভূমিকা:
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট, শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার জন্য তার নিজের দলের কিছু সদস্য, কথিত বৈদেশিক শক্তি এবং সামরিক বাহিনীর অফিসাররা একটি অভ্যুত্থান ঘটান, যার ফলে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য প্রাণ হারান। শেখ মুজিব হত্যার পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদ সংবিধান বহির্ভূতভাবে ক্ষমতায় আসেন। এ ঘটনায় জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, এবং তিনি সমালোচিত হন।
মোশতাকের শাসনকাল এবং জিয়ার পদোন্নতি:
মোশতাক ক্ষমতায় আসার পর, তার শাসন পরিচালনায় শেখ মুজিবের হত্যাকারী সামরিক অফিসারগণ প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন, যার ফলে দেশের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। কিছু সিনিয়র সেনা কর্মকর্তা, যেমন খালেদ মোশাররফ এবং শাফায়াত জামিল, জিয়াকে এই খুনি অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু জিয়া তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হন। এর ফলস্বরূপ, ৩রা নভেম্বর বীর বিক্রম কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে, যার ফলে খন্দকার মোশতাক আহমেদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন।
জিয়াকে গৃহবন্দী করা এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা:
এ সময়, জিয়াউর রহমানকে চিফ অফ আর্মি স্টাফ পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় এবং তাকে তার বাসভবনে গৃহবন্দী করা হয়। তার বাড়িটি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হলেও, তার শোবার ঘরের টেলিফোনটি সচল ছিল, যা পরবর্তী সময়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হয়।
জিয়ার অভ্যুত্থান এবং কর্নেল তাহেরের ভূমিকা
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে একটি গুরুত্বপূর্ণ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে, যা জিয়াউর রহমানের জন্য এক নাটকীয় মোড় নিয়ে আসে। জিয়া ও কর্নেল তাহেরের সম্পর্ক ছিলো বেশ ঘনিষ্ঠ, এবং তাহের গণবাহিনী গঠন করেছিলেন। গণবাহিনীর লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ পদ্ধতির পরিবর্তে চীনা ধরনের "পিপলস আর্মি" বা শ্রেণিবিহীন সেনাবাহিনী গঠন করা। ৭ই নভেম্বর জিয়াকে মুক্ত করার জন্য, তাহের ও জাসদ পরিকল্পনা করেন এবং সেনানিবাসে সহস্রাধিক লিফলেট ছড়িয়ে দেন। এতে বলা হয় যে, খালেদ মোশাররফ ভারতীয় চক্রান্তে ক্ষমতায় এসেছেন এবং জিয়াকে মুক্ত করা দরকার।
এ পরিস্থিতিতে, সিপাহীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাদের সমর্থনে ৭ই নভেম্বর এক অভ্যুত্থান ঘটায়। এই অভ্যুত্থান শুরু হয় "সেপাই সেপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই!" স্লোগানে, যেখানে তারা অফিসারদের হত্যা করতে থাকে। জিয়াকে মুক্ত করে অভ্যুত্থানকারীরা তাকে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি সদরদপ্তরে নিয়ে আসে। এদিন সকালে শেরে বাংলা নগরে, ক্ষুব্ধ জওয়ানদের হাতে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা এবং লেঃ কর্নেল এ টি এম হায়দার নিহত হন।
জিয়া কর্নেল তাহেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার জীবন রক্ষায় ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, "আমি (জিয়া) জীবন দিতে প্রস্তুত তাহের ও জাসদের জন্য।" এরপর জিয়া রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়াই বেতারে ভাষণ দেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে পরবর্তী সময়ে তাকে প্রতিবাদের মুখে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ফিরে যেতে হয়।
সৈনিকদের দাবি ও জিয়ার প্রতিক্রিয়া
অভ্যুত্থানের পর জিয়া সৈনিকদের দাবি পূরণের ব্যাপারে উদাসীনতা দেখান। সৈনিকরা তাদের দাবি অনুযায়ী জিয়াকে 'জনাব জিয়া' বা 'জিয়া ভাই' বলে ডাকতে শুরু করেন, যা জিয়াকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তিনি দ্রুত তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেকে "জেনারেল জিয়া" হিসেবে ঘোষণা করেন। এই কারণে সৈনিকরা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তারা অফিসারদের হত্যা করতে থাকে। অনেক অফিসারকে বোরকা পরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যেতে দেখা যায়।
কর্নেল তাহেরের গ্রেফতার ও মৃত্যুদণ্ড
জিয়া কর্নেল তাহেরকে ২৪শে নভেম্বর গ্রেফতার করেন, এবং তাহেরের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে উস্কানিমূলক কার্যকলাপ এবং সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যদিও তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেওয়া হয়নি। এই বিচারটি ছিল এক প্রহসনমূলক বিচার, এবং বিচারপতি সায়েমের অধীনে, যদিও তিনি বিচারের প্রহসন সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ স্থগিত করার ক্ষমতা দেখাননি। ৩০ বছর পর আদালত তাহেরের মৃত্যুদণ্ডকে অবৈধ এবং পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে আখ্যা দেয়।
সার্বিক পরিস্থিতি ও পরিণতি
এই ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ভেতর এক বড় ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গ হয়, এবং জিয়া ক্ষমতায় আসেন।
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং জিয়ার ক্ষমতা দখল
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫-এর অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়টিতে জিয়া আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে তীব্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের মুখোমুখি হন। অভ্যুত্থানের ফলে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন এবং ১৯শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তাকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চিফ অফ আর্মি স্টাফ পদে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ১৯৭৬ সালে, বেতারে ভাষণে জিয়া নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন, তবে প্রতিবাদের মুখে তিনি উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সায়েমের শাসন ও নির্বাচন প্রক্রিয়া
এদিকে, বিচারপতি সাদাত মোহাম্মদ সায়েম সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার গঠন করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছিলেন। সায়েম তার অত্যন্ত আস্থাভাজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব দেন। তবে, আওয়ামী লীগের সংগঠন এখনও শক্তিশালী ছিল এবং তারা সম্ভাব্য নির্বাচনে বিজয়ের আশাবাদী ছিল। সায়েমের অধীনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলির সদস্যরা সেনানিবাসে সমাবেশ করতে শুরু করেছিল। এই সময়, কিছু রাজনীতিবিদ জিয়াকে নির্বাচন স্থগিত করতে প্ররোচিত করেন, যাতে তারা নিজেদের সুবিধা লাভ করতে পারে।
জিয়ার রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও রাষ্ট্রপতি পদে ওঠা
জিয়া ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি দেশের গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন। ১৯৭৬ সালের ৮ই মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন এবং একই বছর কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান তার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়্যারম্যান পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি তিনি একুশে পদক প্রবর্তন করেন এবং ২১শে এপ্রিল রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত সায়েমের উত্তরসূরি হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন।
গণতন্ত্রায়ণের উদ্যোগ ও বহুদলীয় রাজনীতি
রাষ্ট্রপতি হিসেবে, জিয়া গণতন্ত্রায়ণের পদক্ষেপ নেন এবং দেশে বহুদলীয় রাজনীতি চালুর ঘোষণা দেন। তিনি জানিয়েছিলেন যে, তিনি রাজনীতিতে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করতে চান, যা দেশের রাজনৈতিক পরিসরে নতুন শক্তি এনে দিতে সক্ষম হতো। তার ভাষায়, "I will make politics difficult for the politicians." (আমি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে তুলব) এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি দেশের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে উসকে দেন।
১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও গণভোট
১৯৭৮ সালে, ৩রা জুন অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়াউর রহমান জয়লাভ করেন। এই নির্বাচনে মোট ১০ জন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, যদিও ১১ জন প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে, জিয়া ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং তার কর্মসূচির প্রতি জনগণের আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০শে মে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করে তিনি তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেন।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং জিয়াউর রহমানের ভূমিকা
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের সমাজে বহু জাতিগোষ্ঠী, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের বাস, যার মধ্যে প্রতিটি সংস্কৃতির জীবনযাত্রার ধরন আলাদা। এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে, জিয়া মনে করেন যে জাতীয়তাবাদ ভাষা বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে নয়, বরং ভূখণ্ডের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত।
তিনি বাংলাদেশের সকল নাগরিককে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ বা সংস্কৃতি নির্বিশেষে একত্রিত করার গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, এই জাতীয়তাবাদই দেশের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির শক্তি হতে পারে। তার এই ধারণা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে, যা জাতির মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আইন শৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনী
জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর দেশের আইন শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণ করেন এবং সঠিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সশস্ত্র বাহিনীতেও তিনি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন, এর জন্য তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করেন এবং বাহিনীর সদস্যসংখ্যা বাড়ান।
যদিও তিনি সশস্ত্র বাহিনীতে শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সফল হন, কিন্তু তাকে বেশ কিছু সেনা বিদ্রোহ ও সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এসব বিদ্রোহ দমনে জিয়া কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা তার শাসনের সময়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
জিয়া দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার প্রথম পদক্ষেপ ছিল, বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের আমলে নিষিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনরায় তাদের কার্যক্রম শুরু করার সুযোগ প্রদান করা। এর মাধ্যমে তিনি সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেন এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে তথ্য প্রবাহের সুযোগ তৈরি করেন।
১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে, জিয়া জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রধান হিসেবে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, তিনি জাতীয় ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ৭৬.৬৭% ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন।
নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক শাসন
জিয়ার শাসনে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে, যা দেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও বহুদলীয় রাজনীতির উত্থানকে নিশ্চিত করে। ১৯৭৮ সালের নির্বাচনে তার বিজয় দেশের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক ইতিহাস
১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর, জেনারেল জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আদর্শকে শক্তিশালী করা এবং দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা।
বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর, বেগম খালেদা জিয়া দলের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, যখন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ছিলেন দলের প্রথম চেয়ারম্যান। দলটির প্রথম মহাসচিব ছিলেন অধ্যাপক এ. কিউ. এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী।
বিএনপির বৈশিষ্ট্য ও সদস্য গঠন
বিএনপির অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তার সদস্যদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া। দলের প্রায় ৪৫% সদস্য রাজনীতিতে নতুন, এবং তাদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ ছিলেন। এই দলে বাম, ডান এবং মধ্যপন্থী রাজনৈতিক ধারার লোকেরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে দলটির ঘোষণা দেন এবং প্রায় দুই ঘণ্টা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
দলের প্রতিষ্ঠা এবং প্রথম আহ্বায়ক কমিটি
বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর, প্রথমে ১৮ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। উল্লেখযোগ্য যে, বিএনপি গঠনের আগে, ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার সভাপতি ছিলেন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার। তবে, ১৯৭৮ সালের ২৮শে আগস্ট, জাগদল বিলুপ্ত ঘোষণা করে এবং এর সদস্যরা বিএনপিতে যোগ দেন।
১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচন
১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিএনপি ২৯৮ আসনের মধ্যে ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুটি ভিন্ন দলের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করে। আব্দুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসনে জয়লাভ করে, এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দুটি আসনে জয়ী হয়। এছাড়াও, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৮টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ১টি, এবং মুসলিম ডেমোক্রেটিক লীগ ২০টি আসনে জয়লাভ করে।
জিয়া ও বিএনপির রাজনৈতিক দর্শন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংস্কার
রাজনৈতিক দর্শন: ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ
বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর, জিয়া দলের কর্মীদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক কর্মশালা উদ্বোধনকালে, তিনি রাজনৈতিক আদর্শের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। ধর্মের অবদান থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি করা উচিত নয়।” এর মাধ্যমে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং একটি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ওপর জোর দেন, যা শুধুমাত্র ভূখণ্ডের ভিত্তিতে সকল নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ করে।
পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনেন। তার পররাষ্ট্রনীতি সংস্কারে মূল দুই দিক ছিল:
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্কের দূরীকরণ: জিয়া সোভিয়েত ব্লকের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সীমিত করার চেষ্টা করেন এবং পূর্ব ইউরোপের পারমাণবিক শক্তি চীনসহ মুসলিম বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের সাথে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ: মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশের সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে শীতল ছিল, কিন্তু জিয়া সে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করেন, বিশেষ করে সৌদি আরবের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক যা পরে বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের বৃহত্তম কর্মস্থল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
চীনের সাথে সম্পর্ক এবং সামরিক পুনর্গঠন
জিয়াউর রহমান চীনের সাথে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পুনর্গঠন এবং আধুনিকীকরণে সাহায্য করে। চীন থেকে আধুনিক অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি শক্তিশালী হয়।
সার্কের প্রতিষ্ঠা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা
জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহায়তা সংস্থা (সার্ক) প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। ভারতের সাথে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টির পর, তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সার্কের রূপরেখা রচনা করেন, যা ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একত্রিত হয়ে একে অপরকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়, যা বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ
জিয়া রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সফলতার ফলে ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। এ সময়ে বাংলাদেশ জাপানকে পরাজিত করে এই সম্মান অর্জন করে, যা বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়।
মৃত্যু
জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ ছিল যে, তিনি তার বিরোধিতাকারী সেনা কর্মকর্তাদের নিপীড়ন করতেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে কিছু সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তবে তার শাসনামলে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন এবং ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। তার জনপ্রিয়তার কারণে অনেক উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা তাকে হটানোর জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে, এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া নিহত হন। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তার উপস্থিতির সময় এই ঘটনা ঘটে। জিয়ার মৃত্যু দেশের রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে এক গভীর সংকট সৃষ্টি করে। তাঁর জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়। ১৯৮১ সালের ২৯শে মে চট্টগ্রামে তার আগমনের আগে থেকেই, জিয়া জানতেন যে বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে, তবুও তিনি চট্টগ্রামের স্থানীয় সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে এই প্রাণঘাতী হামলার শিকার হন।