বাল গঙ্গাধর তিলক (Bal Gangadhar Tilak) (২৩ জুলাই ১৮৫৬ – ১ আগস্ট ১৯২০) ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় পণ্ডিত, জাতীয়তাবাদী নেতা, সমাজ সংস্কারক, আইনজীবী এবং স্বাধীনতা কর্মী। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে তিনি ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে "ভারতীয় অস্থিরতার পিতা" বলতেন, এবং তাঁকে সন্মানসূচক লোকমান্য (জনগণ দ্বারা গৃহীত নেতা) উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
রাজনৈতিক ও সামাজিক অবদান
তিলক ছিলেন হোমরুল আন্দোলনের জনক, যা ভারতীয় স্বায়ত্তশাসনের জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল। তিনি 'মারাঠা' ও 'কেশরী' নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, যেখানে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদ এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন।
গীতা রহস্য ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
তিলকের গীতা রহস্য বইটি তার চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ দেয়। এই বইয়ে তিনি গীতার আধ্যাত্মিক বার্তা এবং ভারতীয় সমাজের জন্য তার প্রাসঙ্গিকতা ব্যাখ্যা করেছেন।
রাজনৈতিক জীবন ও কারাবরণ
তিলক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতীয় স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছেন। তিনি ছিলেন ভারতের প্রথম রাজনৈতিক নেতা যিনি জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, এমনকি গান্ধীজির আগেও। তিনি গোখলে থেকে ভিন্নভাবে, সামাজিক রক্ষণশীল কিন্তু জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
তিলক বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেছিলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ম্যান্ডালয় জেলে তার দীর্ঘ সময়কাল। তার রাজনৈতিক জীবনের এক পর্যায়ে ব্রিটিশ লেখক স্যার ভ্যালেন্টাইন চিরোল তাকে "ভারতীয় অশান্তির জনক" বলে অভিহিত করেছিলেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও বাল গঙ্গাধর তিলক
বাল গঙ্গাধর তিলক ১৮৯০ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। তার রাজনৈতিক জীবনে, তিনি আত্মশাসন বা স্বরাজ আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন এবং মধ্যপন্থী মনোভাবের বিরোধিতা করতেন। তিলক ছিলেন এক বিশিষ্ট মৌলবাদী নেতা, এবং ১৯০৫-১৯০৭ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে—মধ্যপন্থী এবং চরমপন্থী।
বুবোনিক প্লেগ এবং হত্যার প্ররোচনা
১৮৯৬ সালের শেষের দিকে, বোম্বে থেকে ছড়িয়ে পড়ে বুবোনিক প্লেগ, যা ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে মহামারী আকারে পৌঁছে। প্লেগ মোকাবিলায় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিরক্তি সৃষ্টি করে। তিলক তার পত্রিকা কেশরীতে এই পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি ভগবদ গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের গুরুত্ব তুলে ধরেন। এর পর ১৮৯৭ সালের ২২ জুন, চাপেকর ভাইরা ব্রিটিশ অফিসার রান্ড এবং আয়ারস্টকে গুলি করে হত্যা করেন। তিলকের বিরুদ্ধে হত্যার প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়, এবং তিনি ১৮ মাস কারাবাসে ছিলেন। কারাগার থেকে মুক্তির পর, তিনি জাতীয় বীর হিসেবে শ্রদ্ধেয় হন এবং তার স্লোগান "স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার এবং এটি আমার থাকবে" একটি জনপ্রিয় উক্তি হয়ে ওঠে।
স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গভঙ্গ
বঙ্গভঙ্গের পর, যা লর্ড কার্জন কর্তৃক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করার একটি কৌশল ছিল, তিলক স্বদেশী আন্দোলন এবং বয়কট আন্দোলনকে উৎসাহিত করেন। তিনি বিদেশী পণ্য বর্জনের পাশাপাশি দেশীয় পণ্য ব্যবহারের উপর জোর দেন। তিলক বলেছিলেন, স্বদেশী এবং বয়কট আন্দোলন দুটি এক মুদ্রার দুই পিঠ।
লাল-বাল-পাল ট্রাইমুইরেট
তিলক, বিপিন চন্দ্র পাল এবং লালা লাজপত রায়—এই তিন নেতা একত্রে লাল-বাল-পাল ট্রাইমুইরেট নামে পরিচিত হন, যারা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক বক্তৃতার ধারা পরিবর্তন করেছিলেন।
মধ্যপন্থী ও মৌলবাদী বিভক্তি
১৯০৭ সালে, গুজরাটের সুরাটে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দলের মধ্যপন্থী এবং মৌলবাদী অংশের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তিলক, পাল এবং লাজপত রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়—মধ্যপন্থী এবং মৌলবাদী। এ সময় অরবিন্দ ঘোষ এবং ভিও চিদম্বরম পিল্লাই জাতীয়তাবাদীরা তিলককে সমর্থন করেন।
ফেডারেল ব্যবস্থা ও হিন্দি ভাষার প্রস্তাব
তিলক একাধিকবার তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। কলকাতায় তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি স্বাধীন ভারতের জন্য ফেডারেল ব্যবস্থা প্রস্তাব করেন, যেখানে সকল রাজ্য সমান অংশীদার হবে। তিনি ছিলেন প্রথম কংগ্রেস নেতা যিনি হিন্দি ভাষাকে ভারতের একমাত্র জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেছিলেন, এবং এর জন্য দেবনাগরী লিপি ব্যবহার করার কথা বলেন।
তিলক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এক শক্তিশালী কণ্ঠ হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং তার প্রস্তাবিত নীতিগুলি ভারতের স্বাধীনতার জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।
তিলকের রাজনৈতিক মামলা ও কারাবাস
বাল গঙ্গাধর তিলককে তার জীবদ্দশায় বহু রাজনৈতিক মামলা মোকাবেলা করতে হয়েছে। ব্রিটিশ ভারত সরকার কর্তৃক তাকে তিনবার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল—১৮৯৭, ১৯০০ এবং ১৯১৬ সালে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে জনমত গঠন এবং ভারতীয় জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর।
১৮৯৭ সালের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
১৮৯৭ সালে, তিলককে কেশরী পত্রিকায় তার লেখা এক নিবন্ধের জন্য ১৮ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই নিবন্ধে তিনি বোম্বে প্লেগ মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। তিলকের এই লেখাগুলি জনমত উত্তেজিত করেছিল, যা তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। এরপর, তিলক ম্যান্ডালয়ে ছয় বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
১৯০০ সালের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
১৯০০ সালে, আবারও তিলকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ভারতীয়-ব্রিটিশ জাতিগত বৈরিতা তীব্র করার অভিযোগ আনা হয়। এই মামলায়, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তিলকের আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত হন। তবে তিলক দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাকে বার্মায় ছয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে বিচারক দিনশো ডি দাভার তিলকের শাস্তি কঠোরভাবে প্রদান করেন। তিনি তিলকের আচরণকে "সহিংসতা প্রচার" এবং "হত্যার অনুমোদন" হিসেবে নিন্দা করেন। তিলক নিজে বলেন, “আমি এখনো বলি যে আমি নির্দোষ, এবং আমি মনে করি, আমার কষ্টের মাধ্যমে আমাকে আমার কলমের চেয়ে বেশি উপকৃত করা হতে পারে।”
বিশেষ জুরি এবং বিচারক দাভারের মন্তব্য
বিশেষ জুরির রায়ে তিলক দোষী সাব্যস্ত হন। বিচারক দাভার তিলকের বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করেন এবং তাকে "ভারতের জন্য অভিশাপ" বলে অভিহিত করেন। তিলক এ সময় বলেছিলেন, “আমি মনে করি, এটা প্রভিডেন্সের ইচ্ছা হতে পারে যে আমি বন্দি হয়ে একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য পূরণ করছি।”
কারাগারে বন্দি জীবন
তিলক ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত ম্যান্ডালয়ে কারাগারে ছিলেন। কারাবাসের সময় তিনি গীতা রহস্য রচনা করেন, যা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উপর তার ধারণাগুলিকে নতুন করে আলোড়িত করেছিল। তার লেখার জন্য অনেক কপি বিক্রি হয়েছিল এবং সেই টাকা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে দান করা হয়েছিল।
এই সময়কাল ছিল তিলকের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে তার রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য এক অমূল্য অবদান রেখেছিল।