সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর- Satyendranath Tagore

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন অগ্রগামী বাঙালি লেখক, সংগীতস্রষ্টা ও ভাষাবিদ, এবং ব্রিটিশ শাসিত ভারতের প্রথম ভারতীয় সদস্য যিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি ব্রিটিশ ভারতের নারী মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং নারীদের শিক্ষার প্রসারেও অবদান রাখেন। তার পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ঠাকুর পরিবারের জোড়াসাঁকো শাখার সদস্য, দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্র এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র।

বাড়িতেই সংস্কৃত ও ইংরেজি শিখে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন এবং হিন্দু স্কুল থেকে ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন।

১৮৫৯ সালে সতেরো বছর বয়সে তিনি জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ওই বছরই সত্যেন্দ্রনাথ তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে সিংহল (বর্তমান শ্রীলঙ্কা) ভ্রমণ করেন।

কর্মজীবন

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম ভারতীয়  হিসেবে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (ICS) যোগ দেন। সেসময় সরকারি উচ্চপদে ভারতীয়দের নিয়োগ ছিল বিরল; ব্রিটিশরা সাধারণত এসব পদ নিজেদের জন্য সংরক্ষিত রাখত। কিছু পদ ভারতীয়দের জন্য উন্মুক্ত করে ১৮৫৩ সালের আইনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়। এই কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে উৎসাহিত হন বন্ধু মনমোহন ঘোষের সহযোগিতায়, যিনি তাকে উৎসাহ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। দুজন মিলে ১৮৬২ সালে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হন সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য।

১৮৬৩ সালের জুন মাসে সত্যেন্দ্রনাথ ICS পরীক্ষায় সফল হন এবং প্রশিক্ষণ শেষে ১৮৬৪ সালে ভারতে ফিরে বোম্বে প্রেসিডেন্সিতে (বর্তমান মহারাষ্ট্র, গুজরাট এবং সিন্ধুর কিছু অংশ নিয়ে) কর্মজীবন শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে তিনি মুম্বাইতে কর্মরত ছিলেন, তবে পরে আমেদাবাদে তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগ লাভ করেন। এরপর তিনি বদলির চাকরিতে সারা ভারত ভ্রমণ করেন। ফলে বিভিন্ন ভাষা শেখার সুযোগ পান এবং ব্রাহ্মসমাজের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। আমেদাবাদ ও হায়দ্রাবাদে ব্রাহ্মসমাজের প্রসারে তার বিশেষ অবদান ছিল।

ভারতীয় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন নেতার সংস্পর্শে আসেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, কাশীনাথ ত্রিম্বক তেলঙ্গ, এবং নারায়ণ গণেশ চন্দবরকর। ৩০ বছরের চাকরিজীবন শেষে তিনি ১৮৯৭ সালে মহারাষ্ট্রের সাতারায় বিচারক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

নারী মুক্তি আন্দোলন

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তার স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নারীমুক্তি আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। রামমোহন রায়ের সময় থেকেই নারীর অধিকার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পেলেও হিন্দু সমাজে নারীর অবমাননাকর অবস্থান সত্যেন্দ্রনাথকে ছেলেবেলা থেকেই উদ্বিগ্ন করেছিল। তার মতে, পরিবারে প্রচলিত পর্দা প্রথা হিন্দু সংস্কৃতির অংশ নয় বরং মুসলিম প্রথার অনুকরণ। তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে নারী স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ করেন এবং চেয়েছিলেন তার জীবনসঙ্গিনী জ্ঞানদানন্দিনীর মধ্যে সেই মূল্যবোধ আনতে।

তবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাধায় প্রথমে জ্ঞানদানন্দিনীর বিদেশযাত্রা সম্ভব না হলেও, পরবর্তীতে তাকে বোম্বাইতে নিয়ে যান সত্যেন্দ্রনাথ। সেখানে, ইংরেজ আইসিএস অফিসারদের স্ত্রীর মতো আচরণ ও পোশাক রপ্ত করেন জ্ঞানদানন্দিনী। এর প্রভাব যখন কলকাতায় দেখা যায়, তখন তা ছিল যুগান্তকারী। জ্ঞানদানন্দিনী প্রথমবারের মতো লাটভবনে একটি ভোজসভায় গিয়ে বাঙালি সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। পরে, ১৮৭৭ সালে সত্যেন্দ্রনাথ তাকে সন্তানসহ ইংল্যান্ড পাঠান, যা ছিল তৎকালীন সমাজে নারীদের জন্য দুঃসাহসিক পদক্ষেপ।

এদিকে, সত্যেন্দ্রনাথের প্রেরণায় তার বোন সৌদামিনী দেবীও সমাজ পরিবর্তনের অগ্রভাগে অংশ নেন। সৌদামিনী তাদের বিদ্রুপের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা লিখে যান, যা নারীমুক্তি আন্দোলনের বাস্তবতাকে স্পষ্ট করে তোলে। সত্যেন্দ্রনাথের এই উদ্যোগে হিন্দু সমাজের মেয়েরা পর্দাপ্রথা ভেঙে সমাজে স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ পায়।

জ্ঞানদানন্দিনীও নারী সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শাড়ি পরার আধুনিক শৈলী প্রচলন করেন, যা আজকের ভারতীয় সমাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তিনি পরিবারে ছেলেমেয়েদের জন্মদিন উদযাপনের প্রথা চালু করেন এবং শিশুদের জন্য ‘বালক’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা বাংলা ভাষার প্রথম শিশুপাঠ্য পত্রিকা হিসাবে শিশু সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ছোটদের জন্য লেখার অনুপ্রেরণা দেয়।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অবদান

ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজে অবদান

ঠাকুর পরিবার ভারতীয় পোশাক ও বাংলা ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। ইংরেজ সমাজের ভাল দিকগুলির প্রশংসা করলেও, সত্যেন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজের সংস্কারের পক্ষে দৃঢ় ছিলেন। দেশাত্মবোধ তাঁর মধ্যে সবসময় সক্রিয় ছিল এবং তিনি তা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

হিন্দুমেলা ও দেশাত্মবোধ
১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে পশ্চিম ভারতে থাকার কারণে তিনি হিন্দুমেলার প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত থাকতে পারেননি, তবে ১৮৬৮ সালের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেন এবং "মিলে সবে ভারতসন্তান, একতান গাহ" গানটি রচনা করেন। এই গানটি ভারতের প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হয়। সত্যেন্দ্রনাথ আরও অনেক দেশাত্মবোধক গান রচনা করেছিলেন, যা জনগণের মধ্যে দেশপ্রেমের অনুভূতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছিল।

ব্রাহ্মসমাজে অবদান
সত্যেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। প্রথম যৌবনে তিনি মনমোহন ঘোষ ও কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে কৃষ্ণনগর কলেজে গিয়ে তরুণ সমাজকে ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট করেছিলেন। ইংল্যান্ডে পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ব্রাহ্মসমাজের উপদেশ প্রদান করতেন। আমেদাবাদে কর্মরত থাকাকালীন তিনি ম্যাক্স মুলরকে ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাঠান, যা পরবর্তী সময়ে মুলরের স্ত্রীর রচিত জীবনীগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।

পারিবারিক জীবন ও সাহিত্যিক মজলিস
অবসর গ্রহণের পর সত্যেন্দ্রনাথ প্রথমে পার্ক স্ট্রিটে এবং পরে বালিগঞ্জে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তার সাহিত্যিক মজলিসের আয়োজন হত, যেখানে পারিবারিক সদস্যদের পাশাপাশি তারকনাথ, মনমোহন ঘোষ, উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত ও বিহারীলাল গুপ্ত প্রমুখ বিশিষ্ট বন্ধুবর্গ নিয়মিত যাতায়াত করতেন। তাদের আলোচনা-বিষয় ছিল বাংলা ভাষা, কবিতার উপাদান, পুরুষের প্রেম, নারীর প্রেম ইত্যাদি, যা একটি বইয়ে গ্রন্থিত হলেও, তা পরিবারের বাইরে প্রকাশিত হয়নি।

সভাপতি হিসেবে অবদান
১৯০০-০১ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। এছাড়াও ১৮৯৭ সালে নাটোরে আয়োজিত দশম বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনের পৌরোহিত্য করেছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সন্তানদের কৃতিত্ব

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুই সন্তান সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০) এবং ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী (১৮৭৩-১৯৬০) ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। তাঁদের ছেলেবেলা ইংল্যান্ডে কাটে, যা তাঁদের শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর
সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চার অধ্যায় উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। এছাড়া তিনি মহাভারতের মূল অংশটির একটি সংক্ষিপ্ত পুনর্লিখন প্রকাশ করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, যা তার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল।

ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী
ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী ছিলেন একজন প্রতিভাবান ফরাসি ভাষাবিদ এবং বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। তার বিশেষ আগ্রহ ছিল রবীন্দ্রসংগীত সম্পর্কে, এবং এতে তার গভীর জ্ঞান ছিল। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ছিলেন তাঁর স্বামী। ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা উপাচার্য, যা তার শিক্ষা ও নেতৃত্বের প্রতি তাঁর গভীর প্রতিশ্রুতি প্রতিফলিত করে।


Post a Comment

Previous Post Next Post