ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

 

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত- (Issorchandra Gupta) (৬ মার্চ ১৮১২ - ২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯) ছিলেন একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি কবি, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক, যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধিক্ষণ ঘটানোর মাধ্যমে আধুনিকতার দিকে বাংলার সাহিত্যিক দৃষ্টি ফেরানোর কাজ করেছিলেন। তিনি সংবাদ প্রভাকর (বা সম্বাদ প্রভাকর) পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে পরিচিত, যা তখনকার বাংলা সাংবাদিকতার এক মাইলফলক ছিল।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে "গুপ্ত কবি" হিসেবেও পরিচিতি দেওয়া হয়, কারণ তাঁর সাহিত্যিক এবং কবিতার কাজগুলি বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন দিশায় পরিচালিত করেছিল। তিনি মধ্যযুগীয় কাব্যধারা থেকে আধুনিক কাব্যধারা-তে স্থানান্তর ঘটানোর মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতা ও সাহিত্যকর্মের গভীর প্রভাব ছিল, এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ তাঁর পরবর্তী অনেক সাহিত্যিক তাঁকে "গুরু" হিসেবে মান্য করেছেন। তাঁর পত্রিকা সম্পাদনা এবং সাংবাদিকতার কাজও বাংলা সাহিত্য ও সমাজের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।

জন্ম এবং পারিবারিক পরিচিতি

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-এর জন্ম ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী (বর্তমানে কাঁচড়াপাড়া) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে। তাঁর প্রপিতামহ নিধিরাম দাশগুপ্ত ছিলেন একজন নামকরা কবিরাজ এবং পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত ছিলেন একজন আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক। তাঁর মায়ের নাম ছিল শ্রীমতি, এবং তাঁর শৈশবেই মায়ের পরলোকগমন ঘটে।

যখন তিনি দশ বছর বয়সী ছিলেন, তখন তাঁর মা মারা যান। এরপর পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করেন, এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে তাঁর মামার বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন।

মহল্লার সাধারণ পরিবারে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তার লেখনী এবং সংস্কৃতির প্রতি গভীর আগ্রহ রাখতেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাঁর বিবাহ হয়েছিল গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবী রেবার সঙ্গে, যা তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল।

শৈশব শিক্ষা জীবন

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-এর শৈশব ছিল বেশ দুঃখময়। মাত্র দশ বছর বয়সে তাঁর জীবনে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যখন তাঁর মা শ্রীমতী দেবী অকালেই প্রয়াণ করেন। এই মাতৃবিয়োগের পর, তাঁকে কলকাতায় চলে আসতে হয় এবং আশ্রয় নিতে হয় জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়িতে

তাঁর শৈশবকাল ছিল কিছুটা অমনোযোগী, বিশেষত লেখাপড়ায়। এই কারণে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তাঁর খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। তবে, অসাধারণ মেধা এবং স্মৃতিশক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরচন্দ্র নিজের চেষ্টায় বাংলা, সংস্কৃত, এবং ইংরেজি ভাষা শিখেন। এর পাশাপাশি, তিনি বেদান্তদর্শন-এ যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করেন, যা পরবর্তীতে তাঁর সাহিত্যিক জীবন এবং দর্শনীয় চিন্তা-চেতনার ভিত্তি তৈরি করে।

কর্ম জীবন

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত হন, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ-এর প্রেরণা এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর-এর সহযোগিতায়। সংবাদ প্রভাকর ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা কিছু দিন বন্ধ থাকার পর ১৮৩৬ সালে পুনরায় চালু হয় এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাকে দৈনিকে রূপান্তর করেন ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে।

এছাড়া, ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংবাদ রত্নাবলী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন এবং ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সাপ্তাহিক পাষণ্ড পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। পরবর্তী বছর তিনি সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন।

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কেবল পত্রিকা সম্পাদনা করতেন না, তিনি গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে কবিগান বাঁধতেন এবং প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের জীবনী রচনা করতেন। প্রায় বারো বছর ধরে তিনি গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে এসব তথ্য সংগ্রহ করেন, যা পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের মূল্যবান অংশ হয়ে ওঠে।

সাহিত্যিক জীবনযাত্রা

ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত। তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও, তার ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। যখন ভারতচন্দ্রের মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠত্ব ক্রমেই বিলীন হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর খণ্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন। তার রচনায় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য, এবং তিনি এই ভঙ্গি কবিয়ালদের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছিলেন। ব্যঙ্গের মাধ্যমে তিনি অনেক গুরুতর বিষয় সহজভাবে প্রকাশ করতে পারতেন।

স্বদেশ এবং স্বসমাজের প্রতি তার অনুরাগ ছিল গভীর। তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নে যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা আজও স্মরণীয়। তিনি সবসময় ইংরেজি প্রভাব মুক্ত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। তার ভাষাছন্দের ওপর বিস্ময়কর অধিকার আমরা দেখতে পাই তার বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) নাটকে।

ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো, ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর এবং কিছু কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে তা প্রকাশ করা। এর মাধ্যমে তিনি পরবর্তী সময়ের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকদের জন্য একটি উপযুক্ত সাহিত্যিক ক্ষেত্র তৈরি করেন।



Post a Comment

Previous Post Next Post