রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে ১৮৬১ – ৭ আগস্ট ১৯৪১) ছিলেন একাধারে একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী এবং দার্শনিক। তাকে "গুরুদেব," "কবিগুরু," এবং "বিশ্বকবি" উপাধি দেওয়া হয়। তার উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের মধ্যে আছে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন, যা তাকে প্রথম অ-ইউরোপীয় ও এশীয় বিজয়ী হিসেবে ইতিহাসে স্থান দিয়েছে। তিনি মোট ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ এবং ১৯১৫টি গান রচনা করেছেন।
ঠাকুরের জন্ম কলকাতার এক ধনাঢ্য ব্রাহ্মণ পরিবারে, তবে তার পূর্বপুরুষদের বসতি ছিল বাংলাদেশের খুলনা জেলার পিঠাভোগ গ্রামে। প্রচলিত বিদ্যালয়ের পরিবর্তে বাড়িতেই গৃহশিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল তার। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন, আর তার প্রথম কবিতা "অভিলাষ" ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। ১৮৮৩ সালে তিনি মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।
তার সাহিত্য রচনার বৈশিষ্ট্য চিত্ররূপময়তা, ভাবগভীরতা, গীতিময়তা, এবং স্বদেশপ্রেম ও মানবপ্রেম। তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন গদ্য এবং প্রবন্ধের মাধ্যমে। এছাড়াও, গ্রামোন্নয়ন এবং দরিদ্র মানুষের শিক্ষার প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। তার রচিত সংগীত "জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে" ভারত এবং "আমার সোনার বাংলা" বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
পারিবারিক ইতিহাস
ঠাকুর পরিবারের আদি পদবী ছিল "কুশারী।" কুশারীরা ভট্টনারায়ণের পুত্র দীন কুশারীর বংশধর, যিনি মহারাজ ক্ষিতিশূরের কাছ থেকে বর্ধমান জেলার কুশ নামক গ্রামটি লাভ করে সেখানে বসতি স্থাপন করেন এবং "কুশারী" নামে পরিচিতি পান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তার গ্রন্থ রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক এর প্রথম খণ্ডে এই বংশপরিচয়টি উল্লেখ করেছেন। দীন কুশারীর অষ্টম বা দশম বংশধর ছিলেন জগন্নাথ, যিনি রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ।
এই ঐতিহ্যবাহী বংশপরম্পরার মধ্যে ঠাকুর পরিবার নিজেদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবদানের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করে, যা পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের জীবনের বিভিন্ন পর্বে প্রতিফলিত হয়েছিল।
প্রারম্ভিক জীবনী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৭ মে ১৮৬১), সোমবার কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মাতা সারদাসুন্দরী দেবী। তিনি তাদের চতুর্দশ সন্তান ছিলেন। ঠাকুর পরিবার ছিল ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা, যা তাদের সংস্কৃতিবান পরিবেশের সঙ্গে জড়িত ছিল।
মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ মাতৃহারা হন। তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশভ্রমণে অনুরাগী ছিলেন, তাই তিনি বছরের অধিকাংশ সময় বাড়ির বাইরে কাটাতেন। ফলে রবীন্দ্রনাথের শৈশব মূলত ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানে অতিবাহিত হয়। তিনি কলকাতার কয়েকটি বিদ্যালয়ে অল্প সময় পড়াশোনা করলেও বিদ্যালয়-শিক্ষায় অনাগ্রহী হওয়ায় গৃহশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করতেন এবং শৈশবে জোড়াসাঁকো বাড়ি, বোলপুর, ও পানিহাটির বাগানবাড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘুরে বেড়াতেন।
১৮৭৩ সালে বারো বছর বয়সে তার উপনয়ন অনুষ্ঠিত হয় এবং তিনি পিতার সঙ্গে দেশভ্রমণে বের হন। তারা শান্তিনিকেতন, পাঞ্জাবের অমৃতসর, এবং পরে হিমাচলের ডালহৌসি অঞ্চলের বক্রোটা বাংলোতে অবস্থান করেন। সেখানে দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে সংস্কৃত ব্যাকরণ, ইংরেজি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও ইতিহাসের পাঠ দিতেন। এছাড়া, দেবেন্দ্রনাথ তাকে উপনিষদ্ ও ধ্রুপদি সংস্কৃত সাহিত্য পাঠে উদ্বুদ্ধ করেন।
১৮৭৭ সালে তরুণ রবীন্দ্রনাথের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে ছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের "মেঘনাদবধ কাব্যের" সমালোচনা, "ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী" (রাধা-কৃষ্ণবিষয়ক কবিতা), এবং "ভিখারিণী" ও "করুণা" গল্প। "ভিখারিণী" বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছোটগল্প হিসেবে স্বীকৃত। ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কবিকাহিনী, এবং এর কিছু পরেই আসে সন্ধ্যাসংগীত (১৮৮২), যার মধ্যে বিখ্যাত কবিতা "নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ" অন্তর্ভুক্ত।
১৮৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডে যান। প্রথমে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন এবং পরে ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তবে সাহিত্যচর্চার প্রতি গভীর আগ্রহের কারণে তিনি এই পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ শেকসপিয়রসহ অন্যান্য ইংরেজ সাহিত্যিকের রচনার সঙ্গে পরিচিত হন এবং মনোযোগ সহকারে রিলিজিও মেদিচি, কোরিওলেনাস, এবং অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা পাঠ করেন।
ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তার অভিজ্ঞতা ও চিন্তাধারা তিনি কলকাতার ভারতী পত্রিকায় চিঠি আকারে লিখে পাঠাতেন। এই চিঠিগুলি তার জ্যেষ্ঠভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচনা সহযোগে য়ুরোপযাত্রী কোনো বঙ্গীয় যুবকের পত্রধারা শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৮৮১ সালে এই পত্রগুলি য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, যা ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম গদ্যগ্রন্থ এবং তার প্রথম চলিত ভাষায় লেখা গ্রন্থ।
১৮৮০ সালে প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটানোর পর কোনো ডিগ্রি না নিয়েই এবং ব্যারিস্টারি পড়া সমাপ্ত না করেই তিনি ভারতে ফিরে আসেন।
১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর (২৪ অগ্রহায়ণ, ১২৯০ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিবাহ সম্পন্ন হয় বেণীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণীর সঙ্গে, যিনি পরে মৃণালিনী দেবী নামে পরিচিত হন। মৃণালিনী দেবীর জন্ম ১৮৭৩ সালে এবং মৃত্যু হয় ১৯০২ সালে। রবীন্দ্রনাথ ও মৃণালিনীর পাঁচ সন্তান ছিলেন:
- মাধুরীলতা (১৮৮৬–১৯১৮)
- রথীন্দ্রনাথ (১৮৮৮–১৯৬১)
- রেণুকা (১৮৯১–১৯০৩)
- মীরা (অতসী) (১৮৯৪–১৯৬৯)
- শমীন্দ্রনাথ (১৮৯৬–১৯০৭)
এঁদের মধ্যে রেণুকা ও শমীন্দ্রনাথ অল্প বয়সেই মারা যান, যা রবীন্দ্রনাথের জীবনে গভীর দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৮৯১ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতার নির্দেশে নদিয়া (বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা), পাবনা, রাজশাহী জেলা এবং ওড়িশার জমিদারি সম্পত্তির তদারকি শুরু করেন। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে তিনি দীর্ঘ সময় কাটান। এখানে "পদ্মা" নামে এক বিলাসবহুল পারিবারিক বজরায় করে গ্রামবাসীর কাছ থেকে খাজনা সংগ্রহ করতে যেতেন এবং আশীর্বাদ প্রার্থনা করতেন। স্থানীয় গ্রামবাসীরা তার সম্মানে ভোজসভার আয়োজন করত, যা তার প্রজাদের সঙ্গে এক বিশেষ সংযোগ তৈরি করে।
১৮৯০ সালে তার কাব্যগ্রন্থ মানসী প্রকাশিত হয়, যা তার কাব্যসাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে বিবেচিত। বিশ থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে তিনি আরও কিছু উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ এবং গীতিসংকলন প্রকাশ করেন, যেগুলির মধ্যে প্রভাতসংগীত, শৈশবসঙ্গীত, রবিচ্ছায়া, এবং কড়ি ও কোমল উল্লেখযোগ্য। ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি সাধনা পত্রিকা সম্পাদনা করেন, যেখানে তার বেশ কিছু উৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হয়। এই পর্বটিকে তার সাহিত্যজীবনের "সাধনা পর্যায়" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
সাধনা পর্যায়ে রচিত ছোটগল্পগুলির একটি সংকলন গল্পগুচ্ছ, যা তার প্রথম চুরাশি গল্পের অর্ধেকই অন্তর্ভুক্ত করে। এই গল্পগুলিতে তিনি বাংলার গ্রামীণ জনজীবনের আবেগময় ও শ্লেষাত্মক চিত্র অঙ্কিত করেছিলেন, যা বাংলা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে।