চর্যাপদ বাংলাসাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত একটি গ্রন্থ, যা বৌদ্ধ সাধকদের রচিত গানের সংকলন। এটি মূলত গূঢ় বৌদ্ধ সাধন প্রক্রিয়া ও দার্শনিক দর্শনের প্রতিফলন এবং অপভ্রংশ ভাষা থেকে বাংলা ভাষার বিবর্তনকালে রচিত। চর্যাপদ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হয়। এতে চব্বিশ জন সিদ্ধাচার্যের রচিত সাড়ে ছেচল্লিশটি গান স্থান পেয়েছে।
চর্যাপদে বাংলা ভাষার আদি রূপ পাওয়া যায়, যেখানে তৎকালীন বাঙালি সমাজ, ভাষার কাঠামো এবং ধর্মীয় চর্চার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। চর্যাপদের গানের ভাষা রূপকধর্মী ও আভাসে ভরা, যা বৌদ্ধ ধর্মের গূঢ় সাধনপদ্ধতি ব্যক্ত করে। এই কারণে এটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের প্রথম অধ্যায় হিসেবে স্বীকৃত।
চর্যাপদের রচনাকাল নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও এর সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। চর্যাপদ কেবল ধর্মীয় গ্রন্থ নয়; বরং এটি প্রাচীন বাংলা সমাজ ও ভাষার প্রতিচ্ছবি, যা বাংলা সাহিত্যের উৎস হিসেবে সর্বজনবিদিত।
চর্যাপদের আবিষ্কার ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন হলেও এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার থেকে এই প্রাচীন বৌদ্ধ পুঁথির খণ্ডিত একটি অংশ উদ্ধার করেন। মূলত ১৮৮২ সালে রাজা রাজেন্দ্র লাল মিত্র প্রথম নেপালের বৌদ্ধ সাহিত্য গবেষণায় এই পুঁথির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন, যা হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে চর্যাপদ অনুসন্ধানে অনুপ্রাণিত করে।
আবিষ্কারের ধারাবাহিকতা ও সংগ্রহের বিবরণ:
- ১৮৯৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রথমবার নেপালে যান বৌদ্ধ ধর্মীয় সাহিত্য ও লোকাচার গবেষণার জন্য।
- ১৮৯৮ সালে দ্বিতীয়বারের নেপাল ভ্রমণে কিছু বৌদ্ধ পুঁথি সংগ্রহ করেন, কিন্তু চর্যাপদ তখনও অধরা ছিল।
- ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপাল ভ্রমণে তিনি নেপালের রাজদরবারের অভিলিপিশালায় "চর্যাচর্যবিনিশ্চয়" নামক পুঁথি আবিষ্কার করেন।
প্রকাশ ও গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ: ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে “হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোঁহা” শিরোনামে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ প্রকাশ করেন। তিনি মোট ৪৬টি পূর্ণাঙ্গ এবং একটি খণ্ডিত পদ পেয়েছিলেন। এই সংকলন বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত। চর্যাপদের প্রকৃত নাম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে, যার মূল কারণ হলো এটি তিব্বতি অনুবাদ থেকে সংগৃহীত একটি পুঁথির নকল মাত্র। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পুঁথিটি আবিষ্কার করেন, সেটিতে নাম হিসেবে "চর্যাচর্যবিনিশ্চয়" উল্লেখ রয়েছে এবং তিনি তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে এই নামটি ব্যবহার করেন। তবে, পরবর্তীতে অনেক পণ্ডিত ধারণা করেন যে, এটি মূল পুঁথির নাম ছিল না, বরং নকলকারীর ভুলবশত এই নাম ধারণ করেছে।
মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী ১৯২৮ সালে প্রথম পদের সংস্কৃত টীকার মধ্যে "আশ্চর্যচর্যাচয়" নামটি দেখতে পান এবং এই নামকেই গ্রন্থটির সম্ভাব্য আসল নাম হিসেবে প্রস্তাব করেন। তাঁর মতে, নেপালি পুঁথিতে ভুলবশত এটি "চর্যাচর্যবিনিশ্চয়" নামে পরিচিতি লাভ করে। যদিও প্রবোধচন্দ্র বাগচী এই নামকেই সমর্থন করেছিলেন, আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই নামের যুক্তিসংগততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি জানান যে, "চর্যাচর্যবিনিশ্চয়" এবং "আশ্চর্যচর্যাচয়" উভয় নামকে মিলিয়ে "চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়" বলে অভিহিত করা সঠিক নয়, কারণ এটি আধুনিক পণ্ডিতদের একটি নতুন ব্যাখ্যা।
অধিকাংশ আধুনিক গবেষকের মতে, চর্যাপদের প্রকৃত নাম "চর্যাগীতিকোষ" হতে পারে এবং এর মূল সংস্কৃত টীকাটি ছিল "চর্যাচর্যবিনিশ্চয়"। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই মতটি সমর্থন করেন।
রচনার সময়কাল
চর্যাপদের রচনার সময়কাল নিয়ে ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে বেশ কিছু মতবিরোধ বিদ্যমান। এটি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত বলে অনেক পণ্ডিত মনে করলেও, আরও প্রাচীন সময়ে এর উৎপত্তি অনুমান করে কিছু বিশেষজ্ঞ ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
মতামতসমূহের বিবরণ:
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচী মনে করেন, চর্যার পদগুলি মূলত দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। এই সময়ে বাংলা অঞ্চলে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনার ব্যাপক প্রচলন ছিল।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন চর্যার সময়কাল আরও ২০০ বছর পিছিয়ে ধরে, খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত বলে মত দেন। তাঁদের মতে, চর্যাপদ বাংলার প্রাচীন বৌদ্ধধর্মীয় ও তান্ত্রিক ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ এবং এই সময়েই এর রচনার সূত্রপাত হয়।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার প্রথম সিদ্ধাচার্য লুইপা সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন যে, অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮০–১০৫৩ খ্রিস্টাব্দ) তিব্বতে যাওয়ার পূর্বে লুইপাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। এই তথ্য থেকে লুইপাদের দশম শতাব্দীতে জীবিত থাকার সম্ভাবনা শক্ত হয় এবং এটি চর্যার সময়কাল দশম শতাব্দীর আগেই হতে পারে না বলে ইঙ্গিত করে।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা পুঁথির তথ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা দেয় যে, পাল রাজা গোবিন্দপালের (১১৫৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকালেই চর্যার রচনাকাল শেষ হয়। পুঁথির রচয়িতা শ্রীকৃষ্ণাচার্যকে অনেকেই চর্যার কাহ্নপাদ বলে চিহ্নিত করেন, যা নাথপন্থি ও মারাঠি সাহিত্যেও কাহ্নপাদের দ্বাদশ শতাব্দীর ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থিতি নির্দেশ করে।
এছাড়া, নেপাল ও তরাই অঞ্চলে শশিভূষণ দাশগুপ্ত ১৯৬৩ সালে "চর্যাপদ" ধাঁচের আরও বেশ কিছু পদ আবিষ্কার করেন, যা "নব চর্যাপদ" নামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৯ সালে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এসব নতুন চর্যাগীতির আবিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে চর্যাগীতি ঐতিহ্য আরও দীর্ঘ সময় ধরে গোপনে রচিত হয়ে আসছিল।
সারমর্মে, অধিকাংশ পণ্ডিত চর্যাপদকে দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বলে অনুমান করেন। তবে, এটি সম্ভবত এর চেয়েও প্রাচীন এবং অষ্টম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে এর রচনার সূচনা হতে পারে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
কবিগণ
চর্যাপদে বর্ণিত কবিগণ সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন। এরা মূলত বৌদ্ধ তান্ত্রিক সিদ্ধাচার্য, যাঁরা বজ্রযান ও সহজযান মতবাদের অনুসারী ছিলেন। ভারতীয় ও তিব্বতি কিংবদন্তিতে এই সিদ্ধাচার্যরা "চৌরাশি সিদ্ধা" নামে বিখ্যাত, তবে তাঁদের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না।
চর্যার কবিরা পূর্ব ভারত, নেপাল, এবং বর্তমান বাংলাদেশ, বিহার, ওড়িশা, ও অসম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছিলেন। আবিষ্কৃত চর্যাপদ পুঁথিতে ২৪ জন কবির নাম উল্লেখিত রয়েছে, তবে তাঁদের রচনাগুলির একটি বড় অংশে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে এবং অধিকাংশ কবির নামের সঙ্গে সম্মানসূচক "পা" যোগ করা হয়।
প্রধান কবিরা ও তাঁদের অবদান:
লুইপাদ: আদিসিদ্ধাচার্য হিসেবে সম্মানিত লুইপাদ, যিনি চর্যার প্রথম এবং ২৯তম পদটি রচনা করেছেন। তিনি মগধের বাসিন্দা ছিলেন এবং রাঢ় ও ময়ূরভঞ্জে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়।
কাহ্ন বা কাহ্নপাদ: সর্বাধিক ১৩টি পদ রচয়িতা কাহ্নপাদ, যিনি কৃষ্ণাচার্য বা কৃষ্ণবজ্র নামেও পরিচিত। তাঁর পদের মধ্যে ১২টি পাওয়া গেছে, যেমন পদ ৭, ৯, ১০, ১১ ইত্যাদি। তিনি ওড়িশার এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন এবং মাগধী ও শৌরসেনী অপভ্রংশজাত বাংলায় পদ রচনা করতেন।
ভুসুকুপাদ: সম্ভবত বাঙালি কবি, যাঁর আটটি পদ পাওয়া যায়। কিছু গবেষক তাঁকে শান্তিপাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন।
সরহপাদ: তাঁর চারটি পদ রয়েছে, যা ২২, ৩২, ৩৮ ও ৩৯ নম্বর পদ।
কুক্কুরীপাদ, শান্তিপাদ, শবরপাদ: এঁরা কয়েকটি করে পদ রচনা করেছেন। যেমন কুক্কুরীপাদ ২, ২০, ৪৮ নম্বর পদ রচনা করেন এবং শান্তিপাদ ১৫ ও ২৬ নম্বর পদ রচনা করেন।
অন্যান্য কবি: বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, মহিণ্ডা, আজদেব, ঢেণ্ঢণ প্রমুখ কবিরাও এক বা দুইটি পদ রচনা করেন। তবে নাড়ীডোম্বীপাদের কোনো পদ পাওয়া যায়নি।
এই কবিগণ তাঁদের তান্ত্রিক অভিজ্ঞতা ও আধ্যাত্মিক সাধনাগুলিকে চর্যাগানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।