আল- কুরআন

 

কুরআন মজিদ (আরবি: القرآن) ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, যা আল্লাহর বাণী হিসেবে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। এটি আরবি ভাষায় রচিত এবং ইসলামের নীতি বিধান সম্বলিত একমাত্র আধ্যাত্মিক আইনগত দলিল। কুরআনকে আরবি সাহিত্যের শীর্ষস্থানীয় রচনা হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এটি ভাষাগত, সঙ্গীতাত্মক এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যও প্রসিদ্ধ।

কুরআন কতগুলো সূরা (অধ্যায়) এবং সূরাগুলি আয়াত (বাক্য) হিসেবে বিভক্ত। কুরআনে মোট ১১৪টি সূরা রয়েছে, যার প্রতিটি সূরা কিছু নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু, যেমন ঈমান, আদর্শ জীবন বিধান, ইতিহাস, এবং মানুষের নৈতিকতা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। এর আয়াত বা পঙ্ক্তির সংখ্যা ,২৩৬টি (কিছু মতানুসারে ,৬৬৬টি)

এটি ইসলামের প্রেরণার মূল উৎস এবং পবিত্রতা আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। এটি আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইলের মাধ্যমে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে তাঁর নব্যুয়তের ২৩ বছর ধরে প্রেরিত হয়েছিল। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে কুরআন আল্লাহর চূড়ান্ত বাণী, যা পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলির পরিপূরক এবং পরবর্তী যুগে মানবজাতির জন্য পথপ্রদর্শক।

কুরআনে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার সংক্ষিপ্ত উল্লেখ রয়েছে, যা বাইবেলসহ অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থের সাথে কিছুটা মিলে যায়। তবে কুরআনের ঘটনাগুলির মধ্যে কিছু অমিলও রয়েছে।

মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, কুরআন অপরিবর্তনীয়। সূরা আল-হিজরের নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন:

আমি স্বয়ং উপদেশগ্রন্থ অবতরণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।

কুরআন শব্দের ব্যুৎপত্তি এবং অর্থ

কুরআন (আরবি: القرآن) শব্দটি আরবি فعل "قرأ" (ক্বারা') থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ "পড়া" বা "পাঠ করা" এই শব্দের মূল অর্থ হলো "পাঠ করা" বা "পড়ে শোনানো" এই শব্দটি আরবি ব্যাকরণে "মাসদার" হিসেবে ব্যবহৃত হয়, অর্থাৎ এটি একটি ভাববাচক বিশেষ্য, যা কোনো ক্রিয়ার ফল বা অবস্থাকে নির্দেশ করে।

 অতএব, কুরআন শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো "পঠিত গ্রন্থ" বা "যেটি পাঠ করা হয়েছে" তবে এর বিশেষ অর্থে কুরআন শব্দটি শুধু পাঠ বা আবৃত্তি করাকেই নির্দেশ করে না, বরং একাগ্রভাবে, অধ্যবসায়সহ বা মনোযোগ দিয়ে পাঠ বা আবৃত্তি করাকে বোঝায়। কুরআনে, সূরা আল-কিয়ামাহ তে কুরআন শব্দটি এই ভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে:

অতঃপর, আমি যখন তা পাঠ করি, তখন আপনি সেই পাঠের অনুসরণ করুন।

কুরআনকে "আল-ফুরকান" (পৃথককারী) বলা হয়েছে, যা সত্য মিথ্যার পার্থক্যকে স্পষ্ট করে। "হিকমাহ" শব্দটি কুরআন এবং আল-কিতাবের সাথে সম্পর্কিত, যা বোঝায় প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং দিকনির্দেশনা। কুরআনে আল-কিতাবের সাথে হিকমাহ উল্লেখিত হয়েছে (:১২১, ১৫১; :১৬৪; ৬২:) এটি কুরআনের শিক্ষা জ্ঞানের গভীরতা এবং তার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে।

সূরা (سورة): এই শব্দটি আরবি শব্দ "সূর" (نقطة أو جدار) থেকে এসেছে, যার অর্থ "নগর প্রাচীর" বা "বেষ্টনী" সূরা হলো কুরআনের একটি নির্দিষ্ট অংশ বা অধ্যায়। আয়াত (آية): আয়াত শব্দের মূল অর্থ হলো "নিদর্শন" বা "চিহ্ন", যা আল্লাহর অস্তিত্ব, ক্ষমতা এবং অলৌকিকতার প্রমাণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কুরআনে কিছু আয়াত সরাসরি বা সুস্পষ্ট, কিছু আয়াতের একাধিক অর্থ থাকতে পারে।

নাজিল ও সংকলনের ংকলনের

মুহাম্মদ (সা.)হেরা গুহায় অবস্থানকালে প্রথম কুরআন-এর বাণী  প্রাপ্ত হন এখানেই প্রথম "ইকরা" (পড়) শব্দ দিয়ে নবীকে কুরআন পাঠ করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল এর পরবর্তী ২৩ বছর ধরে, কুরআন একাধিক আয়াতে মুহাম্মদের (সা.) কাছে অবতীর্ণ হতে থাকে। মদিনায় হিজরত করার পর, মুহাম্মদ (সা.) একটি স্বাধীন মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে কুরআনের শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া এবং তেলাওয়াত একটি প্রধান দায়িত্ব ছিল। তিনি তাঁর সাহাবাদের কুরআনের আয়াত শিখতে সম্প্রচার করতে উৎসাহিত করেন, এবং তারা বিভিন্ন স্থানে কুরআন তেলাওয়াত এর শিক্ষা প্রচার করতে থাকেন।

মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় কুরআনটি বই আকারে লিপিবদ্ধ ছিল না, তবে আয়াতগুলি আলাদা আলাদা অংশে লিখিত ছিল এবং সাহাবিরা সেগুলিকে মুখস্ত করতেন। প্রথমদিকে, কুরআনের আয়াতগুলি খেজুরের ডাল, হাড়, পাথর, চামড়া বা অন্যান্য সহজলভ্য উপকরণে লিখিত হত। তবে, ৬৩২ সালে মুহাম্মদ (সা.)-এর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কুরআন একত্রিতভাবে সংকলিত ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর, খলিফা আবু বকর (রা.)-এর সময়, কুরআন সংকলন শুরু হয়।

হযরত আবু বকর (রা.)-এর শাসনামলে, ইয়ামামার যুদ্ধের সময় সত্তর জন হাফেজে কুরআন শহীদ হন, যা হযরত ওমর (রা.)-কে উদ্বিগ্ন করে তোলে। তিনি আবু বকর (রা.)-কে পরামর্শ দেন কুরআন একত্রিত করে সংকলন করার জন্য, যাতে কুরআনের অংশ বিলুপ্ত না হয়।হযরত আবু বকর (রা.)-এর অনুরোধে, কুরআন সংকলনের দায়িত্ব দেয়া হয় হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-কে, যিনি নিজেও হাফেজে কুরআন ছিলেন। তিনি কুরআনের আয়াতগুলি সংগ্রহ করতে দুইটি পদ্ধতি অনুসরণ করেন: একদিকে, যাদের মুখস্থ ছিল, তাদের থেকে শোনা হতো, আরেকদিকে, মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় লিখিত আয়াতগুলির পাণ্ডুলিপি যাচাই করে সংকলন করা হতো।

যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)-এর নেতৃত্বে কুরআন একত্রিত করা হয় এবং এটি হযরত আবু বকর (রা.)-এর তত্ত্বাবধানে রাখা হয়। তার পর, হযরত আবু বকরের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে, এটি হযরত ওমর (রা.)-এর কাছে চলে আসে এবং তার মৃত্যু পর এই কুরআনের প্রতিলিপিটি মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী  হযরত হাফসা (রা.)-এর কাছে সঞ্চিত থাকে।

পরে, ইসলামের ব্যাপক প্রসারের সাথে সাথে, বিভিন্ন জাতি ভাষাভাষী মুসলিমদের মধ্যে কুরআন তেলাওয়াতের পদ্ধতিতে কিছু পার্থক্য দেখা দেয়। বিশেষ করে আরমেনিয়া এবং আজারবাইজান যুদ্ধের সময়, হুযাইফা (রা.) খলিফা উসমান (রা.)-কে কুরআনের পাঠের এই ভিন্নতা সম্পর্কে অবহিত করেন। এর পর, খলিফা উসমান (রা.) কুরআনের একটি একক এবং মানক সংস্করণ তৈরি করতে চারজন বিশিষ্ট সাহাবী, যেমন হযরত আবু মুসা আল-আশআরী, হযরত আলী (রা.)-সহ অন্যান্য নেতৃস্থানীয় সাহাবীগণের সমন্বয়ে একটি বোর্ড গঠন করেন। এই বোর্ড হযরত হাফসা (রা.)-এর কাছে সংরক্ষিত মূল কপিটি অনুসরণ করে লিখিত এবং উচ্চারণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মান নির্ধারন করে্ কুরাইশি উচ্চারণে কুরআনের সাতটি প্রতিলিপি তৈরি করে, যা পরবর্তীতে মক্কা, শাম, ইয়েমেন, বাহরাইন, বসরা, কুফা, এবং মদিনার মতো বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। এভাবে, কুরআন একটি একক নির্ভুল রূপে বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছায় এবং মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি দূর করা হয়। এর পর, বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য পুরোনো, বিক্ষিপ্তভাবে সংরক্ষিত কুরআনের অন্যান্য প্রতিলিপিগুলো সবাই থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং বিনষ্ট করা হয়। এই উদ্যোগের কারণে, হযরত উসমান (রা.)-কে "জম'আল কুরআন" বা "কুরআন সংগ্রহকারী" বলা হয়।

কুরআনের অলৌকিক বৈশিষ্ট্য (ইজায):

·  অননুকরণীয়তা: কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যার শৈলী, ভাষা, বিষয়বস্তু, এবং আবেদন-প্রভাবের কারণে মানবজাতির পক্ষে অনুরূপ কিছু সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এটি বিশেষভাবে মহান আল্লাহর অলৌকিক গুণাবলীর প্রকাশ।
কুরআনে কিছু আয়াতে সম্পর্কে বলা হয়েছে:

"যদি এই কুরআনের অনুরূপ কুরআন রচনা করার জন্য মানুষ জ্বীন সমবেত হয় এবং তারা পরস্পরকে সাহায্য করে, তবুও তারা এর অনুরূপ কুরআন রচনা করতে পারবেনা।" (সূরা আল-ইসরা)

·  বৈজ্ঞানিক তথ্য: অনেক পণ্ডিতরা কুরআনে কিছু বৈজ্ঞানিক তথ্য খুঁজে পেয়েছেন, যা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়া, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, এবং পৃথিবীর অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ সম্পর্কিত কিছু আয়াত আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব বৈজ্ঞানিক তথ্য কুরআনের অলৌকিকতার সাক্ষ্য দেয়।

·  মুহাম্মাদ (সা.)-এর নিরক্ষরতাও একটি প্রমাণ: মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী, মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন নিরক্ষর, অর্থাৎ তিনি লেখা-পড়া জানতেন না। তার কাছ থেকে এমন একটি অলৌকিক গ্রন্থ বেরিয়ে আসা, যা শৈলী, ভাষা, এবং বিষয়বস্তু হিসেবে অনুকরণীয় নয়, এটি তার নবুয়ত এবং কুরআনের ঈশ্বরিক অধিকারকে আরও দৃঢ় প্রমাণ করে।

নামাজে কিরাআত (কুরআন তিলাওয়াত) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং নামাজকে বিশুদ্ধ পূর্ণাঙ্গ করতে হলে সঠিকভাবে কিরাআত তিলাওয়াত করা আবশ্যক। ফরজ নামাজের প্রথম দুই রাকাআতে সুরা ফাতিহা তিলাওয়াত করা বাধ্যতামূলক। এটি নামাজের একটি আবশ্যক অংশ, এবং এর সাথে অন্য একটি সুরা মিলানো ওয়াজিব। সুরা ফাতিহার পর কমপক্ষে তিনটি আয়াত তিলাওয়াত করতে হবে। তবে তিনটি আয়াতের সমপরিমাণ বড় একটি আয়াত হলেও তা যথেষ্ট বলে ধরা হয়। কিরাআত তিলাওয়াতের সময় শুদ্ধ উচ্চারণ এবং মনোযোগ রাখা জরুরি। তিলাওয়াতের সময় আয়াতগুলো সঠিকভাবে উচ্চারণ করা এবং কুরআনের অর্থ নিয়ে গভীরভাবে মনোযোগী হওয়া নামাজে মনোযোগ বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।

মূল বিষয়বস্তু

কুরআনের বিষয়বস্তু ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসসমূহকে কেন্দ্র করে গঠিত। এর মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব, একত্ববাদ, এবং পুনরুত্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর আলোচনা রয়েছে। এছাড়া কুরআন পূর্ববর্তী নবিগণের জীবনের ঘটনা এবং শিক্ষাকে তুলে ধরে, যা মুসলমানদের জন্য নৈতিক আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে।

কুরআনে এমন কিছু আয়াত রয়েছে যা নৈতিক আইনগত বিষয়ে নির্দেশনা দেয়, যেমন সামাজিক ন্যায়, দানশীলতা, এবং নামাজের গুরুত্ব। মুহাম্মাদের (সঃ) জীবদ্দশায় ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনাবলীও এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কুরআনে বর্ণিত প্রাকৃতিক ঘটনাবলীর আয়াতগুলো অনেক মুসলমান কুরআনের বার্তার সত্যতা এবং এর ঐশ্বরিক উৎসের ইঙ্গিত হিসেবে দেখেন, কারণ এগুলোতে প্রকৃতির নিয়ম মহাজাগতিক বিষয়ের সুনির্দিষ্ট বর্ণনা রয়েছে, যা মানুষের চিন্তাশক্তিকে উদ্দীপিত করে এবং তাদের আল্লাহর সৃষ্টির বিস্ময়ের প্রতি মনোযোগী করে।

কুরআনের কেন্দ্রীয় ধারণা একেশ্বরবাদ বা আল্লাহর একত্ব। কুরআনে আল্লাহকে জীবন্ত, চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপী এবং সর্বশক্তিমান সত্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহর সৃষ্টির ক্ষমতা এবং শক্তিমত্তা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে প্রকাশ পেয়েছে।

কুরআনে বারবার আল্লাহর ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরতার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, মানুষের প্রকৃত কল্যাণ নিহিত রয়েছে এই সত্যকে মেনে নিয়ে সেই অনুসারে জীবন পরিচালনার মধ্যে। এতে মানুষের জন্য আল্লাহর প্রতি সমান নির্ভরতার দিকটি জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য কুরআনে সৃষ্টিতাত্ত্বিক যুক্তিও ব্যবহৃত হয়েছে।

কুরআনে ২৫ জন নবীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন হযরত আদম, হযরত নূহ, হযরত ইদ্রিস, হযরত হুদ , হযরত সালেহ, হযরত ইব্রাহিম, হযরত সমাইল, হযরত ইসহাক, হযরত লুত, হযরত য়াকুব, হযরত ইউসুফ, হযরত শোয়াইব, হযরত মুসা, হযরত হারুণ, হযরত ইলিয়াস, হযরত আল-ইয়াসা , হযরত দাউদ, হযরত সোলাইমান, হযরত আইয়ুব, হযরত ইউনুস, হযরত যুলফিকল, হযরত যাকারিয়া, হযরত ইয়াহিয়া, হযরত ঈসা এবং হযরত মুহাম্মদ ((স.)

কুরআন অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের মধ্যে মিল ও অমিল

কুরআন অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মিল এবং মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ পৃথিবীর বিভিন্ন যুগে মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্য নবী রাসূলদের মাধ্যমে বিভিন্ন ঐশী গ্রন্থ নাজিল করেছেন। এই গ্রন্থগুলোর মধ্যে তাওরাত (মুসার প্রতি), যাবুর (দাউদের প্রতি), ইনজিল (ঈসার প্রতি) এবং কুরআন (মুহাম্মাদের প্রতি) উল্লেখযোগ্য। এই ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে কুরআনকে ইসলামে শেষ পরিপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিচে কুরআন অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের কয়েকটি প্রধান মিল অমিল নিয়ে আলোচনা করা হলো:

মিল

  1. ঐশী উৎস: কুরআনসহ সব ঐশী গ্রন্থকেই ইসলাম আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ বলে বিশ্বাস করে। প্রতিটি গ্রন্থই তাদের যুগের মানুষদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য আল্লাহর বাণী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।
  2. একেশ্বরবাদের শিক্ষা: কুরআন, তাওরাত, যাবুর, এবং ইনজিল সকলেই এক ঈশ্বরের ধারণা প্রচার করেছে। প্রত্যেকটি গ্রন্থেই এক ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন এবং তার নির্দেশ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।
  3. নৈতিকতার প্রতি গুরুত্ব: সব ঐশী গ্রন্থেই সততা, দানশীলতা, সহানুভূতি, এবং ধর্মীয় আদেশ-নিষেধ পালনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সঠিক পথ অনুসরণের জন্য এই গুণাবলী অর্জনের ওপর সব গ্রন্থেই বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে।
  4. বিচার দিবস পরকালের ধারণা: কুরআনসহ অন্যান্য ঐশী গ্রন্থেও বিচার দিবস, পুনরুত্থান, এবং পরকালে পুরস্কার শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। সকল গ্রন্থেই ঈশ্বরের সামনে মানুষকে তাদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
  5. ঐতিহাসিক ঘটনাবলি: আদম, নূহ, ইবরাহিম, মুসা, এবং দাউদ প্রমুখের কথা কুরআন, তাওরাত, এবং বাইবেলের বিভিন্ন অংশে উল্লেখ আছে। এদের জীবন ঘটনা থেকে মানবজাতির জন্য শিক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

অমিল

  1. প্রকৃতির বিশুদ্ধতা: ইসলামিক বিশ্বাস অনুযায়ী কুরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবিকৃত এবং মূল আরবিতেই সংরক্ষিত রয়েছে। তবে অন্যান্য ঐশী গ্রন্থ, যেমন তাওরাত ইনজিল, তাদের মূল পাঠ্য পরিবর্তিত হয়েছে বলে মুসলমানরা মনে করেন। মুসলমানদের মতে, কুরআন আল্লাহর চূড়ান্ত বাণী এবং এটি পরবর্তী কোনো সংশোধনের প্রয়োজন নেই।
  2. রীতি বিধান: প্রতিটি ঐশী গ্রন্থ নিজ নিজ যুগের মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বিধি-বিধান প্রদান করেছে। উদাহরণস্বরূপ, তাওরাতে মুসার সময়ের ইসরাইলীদের জন্য নির্দিষ্ট আইন বিধি-বিধান ছিল, যেখানে কুরআন মোতাবেক সব যুগের জন্য চূড়ান্ত বিধান নির্ধারণ করা হয়েছে এবং ইসলামিক জীবনযাপনের নিয়মাবলী প্রদান করা হয়েছে।
  3. মুহাম্মাদকে শেষ নবী হিসেবে স্বীকৃতি: কুরআনে মুহাম্মাদকে শেষ নবী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না। অন্যদিকে, অন্যান্য ঐশী গ্রন্থে শেষ নবীর এই ধারণা স্পষ্ট নয়। ইসলাম মতে, মুহাম্মাদ আগের সব নবীদের প্রচারিত ধর্মের চূড়ান্ত সংস্করণ নিয়ে এসেছেন।
  4. শাস্ত্রের ভাষা সংরক্ষণ: কুরআন মূল আরবি ভাষায় অবিকৃত অবস্থায় রয়ে গেছে, তবে অন্যান্য গ্রন্থগুলোর মূল ভাষা থেকে অনুবাদ ব্যাখ্যার মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়েছে। তাওরাতের মূল ভাষা ছিল হিব্রু এবং ইনজিলের প্রধান অংশগুলো ছিল গ্রীক আরামিকে রচিত, এবং আজকাল অনেক স্থানেই অনুবাদের মাধ্যমে পাঠ্য পরিবর্তিত হয়েছে।
  5. আচার-পদ্ধতির পার্থক্য: কুরআন এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থের অনুসারীদের ধর্মীয় আচার-পদ্ধতিতেও পার্থক্য আছে। যেমন, ইসলামে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রমজানের রোজা, এবং হজ পালন বাধ্যতামূলক, যা তাওরাত ইনজিলে সরাসরি নেই।
  6. পূর্ববতী গ্রন্থের সমর্থন সংশোধন: কুরআনে বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলো সঠিক পথে দিকনির্দেশনা দিয়েছিল, তবে কিছু জায়গায় কুরআন তাদের সংশোধন পূর্ণতা প্রদান করেছে। ইসলাম অনুসারে, পূর্ববর্তী গ্রন্থগুলোতে পরিবর্তন বিকৃতি ঘটেছে এবং কুরআন সেইসব বিকৃতির পরিপূরক হিসেবে প্রেরিত হয়েছে।

 

 

 

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post