কবিগান মূলত দুই দলের মধ্যে প্রশ্নোত্তরভিত্তিক গানের প্রতিযোগিতা বা "বাদাবাদি" আকারে অনুষ্ঠিত হয়। এতে এক দল প্রশ্ন গানে "চাপান" দেয়, আর অন্য দল তার জবাবে "উতোর" গান পরিবেশন করে। এই চাপান-উতোরের টক্কর চলতে থাকে যতক্ষণ না বিচারকরা বা দর্শকরা কোন একটি দলকে বিজয়ী বলে বিবেচিত করেন।
এই গানের ধারা বাংলার লোকসংগীতের মধ্যে অসাধারণ একটি ধারা হিসেবে পরিচিত, যা শুধুমাত্র গানের সৌন্দর্যকেই নয়, বরং কবিয়ালের জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা এবং কাব্যিক দক্ষতারও মূল্যায়ন করে।
ইতিহাস
সজনীকান্ত দাশ তার বাংলার কবিগান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, কবিগানের উৎপত্তি এবং বিকাশের পেছনে বাংলা অঞ্চলের বিভিন্ন সাংগীতিক ধারার মিলন ঘটেছে। এই সব সাংগীতিক ধারাগুলি যেমন তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি একে অপরের সাথে মিশে কবিগানের ধারা গড়ে তুলেছে। এসব ধারার বৈচিত্র্য কবিগানের সৃষ্টিতে একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছে।
ড. সুশীল কুমার দে বলেন যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতেই কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে, কবিগানের প্রকৃত বিকাশকাল ছিল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে। এই সময়ে বাংলা কাব্যের ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক উপাদানগুলি ধীরে ধীরে ফিকে হতে শুরু করেছিল এবং বাংলা কাব্য বৈষ্ণব কবিতার সীমানা থেকে বেরিয়ে আসছিল। মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এই পরিবর্তনের কাজটিকে আরো ত্বরান্বিত করেছিল।
এই সময়ের পরবর্তী কয়েক দশকে, বিশেষ করে নব্য কবিগান এবং পাঁচালি গান কলকাতা এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এমনকি তখনকার সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলিও কিছুটা উপেক্ষিত হতে শুরু করেছিল, কারণ কবিগান এবং পাঁচালি গান এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তবে, কলকাতায় এর জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস পেলেও গ্রামবাংলায় কবিগানের জনপ্রিয়তা অব্যাহত থাকে এবং এটি গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি অমূল্য অংশ হয়ে ওঠে।
এভাবে, কবিগান একদিকে যেমন বাংলা লোকসংগীতের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে, তেমনি এটি বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বিকাশে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
কবিয়ালদের ইতিহাস
বাংলার কবিগান এবং কবিয়ালদের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং একাধিক কবিয়াল জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, বিশেষত অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে। সেই সময়ের মধ্যে বীরভূম জেলাতেই প্রায় শতাধিক কবিয়াল ছিলেন যারা কবিগান পরিবেশন করেছেন এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
গোঁজলা গুঁই, যিনি ১৭০৪ সালের আশপাশে ছিলেন, ছিলেন অন্যতম প্রাচীন কবিয়াল। তার একটিমাত্র গান ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গোঁজলা গুঁইয়ের শিষ্যরা যেমন লালু–নন্দলাল, কেষ্টা মুচি, রঘুনাথ দাস, এবং রামজি পরবর্তীতে বিখ্যাত কবিয়াল হিসেবে উঠে আসেন। শোনা যায়, রঘুনাথ দাস দাঁড়া কবির প্রবর্তক ছিলেন, যা এক নতুন ধারা হিসেবে পরিচিত হয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিখ্যাত কবিয়ালদের মধ্যে হরু ঠাকুর (১৭৪৯–১৮২৪), নিত্যানন্দ বৈরাগী (১৭৫১–১৮২১), রাম বসু (১৭৮৬–১৮২৮), ভোলা ময়রা, যজ্ঞেশ্বরী দাসী, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, এবং ভবানী বণিক ছিলেন। তাদের গানে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকতেন। বিশেষত ভোলা ময়রা-এর গান ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়, এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার গান এবং পরিবেশনা সম্পর্কে অত্যন্ত প্রশংসা করেছিলেন।
বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের কবিয়ালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বলহরি দে (১৭৪৩–১৮৪৯), শম্ভুনাথ মণ্ডল (১৭৭৩-১৮৩৩), তারকচন্দ্র সরকার (১৮৪৫–১৯১৪), রমেশচন্দ্র শীল (১৮৭৭–১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২–১৯৭৪), বিনয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩–১৯৮৫), স্বরূপেন্দু সরকার (১৯৩৩-২০০৯), এবং গৌতম মজুমদার (১৯৭৪-২০১৯)। এছাড়াও, সাতু রায় এবং ঠাকুরদাস চক্রবর্তী-এর মতো কবিয়ালদেরও উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে।
চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রকৃতপক্ষে একজন কবিয়াল ছিলেন এবং বালিকা বধূ ছবিতে তার চরিত্রটি চিত্রিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুকুন্দ দাসের গান জনসাধারণকে প্রভাবিত করেছিল, যা ছবির মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, যিনি জন্মসূত্রে পর্তুগিজ ছিলেন, তার জীবনীও জনপ্রিয় হয়েছে এবং তার উপর ভিত্তি করে দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। একটি ছবিতে উত্তম কুমার এবং অন্যটিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
এই সমস্ত কবিয়াল এবং তাদের গান বাংলা লোকসংগীতের একটি অমূল্য অংশ, যা শুধুমাত্র সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রিয় ছিল না, বরং বাংলা সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ সত্তা হিসেবে অবিচ্ছেদ্য হয়ে আছে।
মুদ্রণ
কবিগান মূলত একটি মৌখিক সাংস্কৃতিক ধারা হিসেবে শুরু হয়েছিল, যেখানে কবি বা কবিয়ালরা মুখে মুখে কবিতা রচনা করতেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গাইতেন। সেই সময়ে, যেহেতু ছাপাখানা ছিল না, এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক বা সমর্থকরা কখনোই কবিগান সংগ্রহ করার কথা ভাবেননি, তাই এই গানগুলি লিখিত আকারে সংরক্ষিত থাকেনি।
১৮৫৪ সালে কবি ঈশ্বর গুপ্ত প্রথমবারের মতো কবিগান সংগ্রহ শুরু করেন এবং তা সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় প্রকাশ করতে শুরু করেন। ঈশ্বর গুপ্তের এই উদ্যোগ কবিগানের ইতিহাসে একটি মাইলফলক ছিল, কারণ এটি মৌখিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লিখিত আকারে রেকর্ড করে তার বিস্তার ঘটাতে সাহায্য করেছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাটি ছিল কবি ঈশ্বর গুপ্তের নিজস্ব পত্রিকা, এবং এর মাধ্যমে কবিগানটি শ্রীবৃদ্ধি লাভ করে।
এভাবে, পত্রিকার মাধ্যমে কবিগানের লিখিত সংগ্রহ সম্ভব হয়ে ওঠে এবং এটি এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যেখানে মৌখিক সাহিত্য থেকে লিখিত সাহিত্য-এর দিকে উত্তরণ ঘটে।